ঘূর্ণিঝড় হামুনে গৃহহীন হাজারো মানুষ, পায়নি ত্রাণসহায়তা
কক্সবাজার-চট্টগ্রামের উপকূলীয় সাত উপজেলায় অন্তত ৪০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। ছয়জনের মৃত্যু।
ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় কক্সবাজার-চট্টগ্রামের উপকূলীয় সাত উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব উপজেলায় অন্তত ৪০ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। কেউ কেউ প্রতিবেশী ও স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ত্রাণসহায়তা পায়নি উপদ্রুত এলাকার লোকজন।
ঝড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কক্সবাজারের সদর, পৌরসভা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া ও পেকুয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া। ঝড়ের পর থেকে বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে বেশির ভাগ এলাকা।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয় ঝোড়ো হাওয়া, যা চলে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। এ সময় দেয়াল, টিনের চালা ও গাছের চাপায় মারা গেছেন ছয়জন। এর মধ্যে কক্সবাজার সদর, চকরিয়া ও মহেশখালী উপজেলায় তিনজন এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে দুজন ও সাতকানিয়ায় একজন মারা গেছেন।
কক্সবাজার পৌরসভার তথ্যানুযায়ী, ঝোড়ো হাওয়ায় ৩০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি-দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছ ভেঙেছে এক লাখের বেশি। কয়েক কিলোমিটার বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে, উপড়ে পড়েছে অসংখ্য খুঁটি। মঙ্গলবার রাত আটটা থেকে গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় গতকাল শহরের ২০টি দৈনিকের কোনোটিই প্রকাশিত হয়নি। তবে গতকাল রাত আটটার পর শহরের একাংশে বিদ্যুৎ চালু হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শহরের বাইরে চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ব্যাপক হারে ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙেছে। গাছপালা উপড়ে পড়ে মহেশখালী থেকে শাপলাপুর পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটারের জনতা বাজার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে উপজেলাগুলোর বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন দ্রুত ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা অতি দ্রুত স্বাভাবিক করা হবে।
ঘর নেই, ত্রাণও পায়নি
কক্সবাজার পৌরসভার একেবারে উত্তর দিকে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা বন্দরপাড়া। এটি পড়েছে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে। এখানে পাঁচ শতাধিক শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ঝড়ে লন্ডভন্ড পুরো গ্রাম।
গ্রামের মধ্যভাগে ভাঙা ঘরের বাঁশ সংগ্রহ করছিলেন দেলোয়ার হোসেন (৪০) নামের এক ব্যক্তি। শহরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালানোর কথা তুলে ধরে দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে যখন ঘূর্ণিঝড় হামুন আঘাত হানার কথা বলা হচ্ছে, তখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি শহরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। গতকাল সকালে গ্রামে এসে দেখেন ঘরের চিহ্ন নেই। আশপাশে কয়েকটি বাঁশ পড়ে আছে। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার।
দুপুরে ছেলেমেয়েদের হালকা নাশতার ব্যবস্থা করা গেলেও রাতে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে জানিয়ে দেলোয়ার বলেন, বৃষ্টি হলে খোলা আকাশের নিচে সবাইকে ভিজতে হবে। এখন পর্যন্ত কেউ তাঁদের খোঁজ নিতে আসেননি।
একটু দূরে বিধ্বস্ত আরও ২০-২৫টি ঘর। ঘরের আশপাশে বসে আছেন কয়েকজন নারী–শিশু। একটি ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শুঁটকিশ্রমিক শামশুল আলম (৫০) ও তাঁর স্ত্রী সিরাজু বেগম (৪০)। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তাঁরাও আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। পরদিন সকালে এসে দেখেন ঘরের চিহ্ন নেই।
পাশের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, ফদনারডেইল এলাকায়ও কয়েক শ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে এই ওয়ার্ডে অন্তত ৩০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও কয়েক শ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি কিছু পরিবারকে নগদ সহায়তা দিলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দ্রুত ত্রাণ ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, কক্সবাজার পৌরসভা ও সদর, রামু, ঈদগাঁও, চাকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালীকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা নগদ অর্থ ও ১৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবারও বরাদ্দ করা হয়েছে। দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এই সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।
ঘূর্ণিঝড়ে তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার আবদুল খালেক (৪২), মহেশখালী উপজেলার বড়মহেশখালী ইউনিয়নের গোরস্তান পাড়ার হারাধন দে (৪৫) ও চকরিয়া উপজেলার বদরখালী গ্রামের আসকার আলী (৪৫)।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরাম বলেন, হামুনের আঘাতে কক্সবাজার শহর লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির তালিকা করে সবাইকে ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হবে।
ক্ষতচিহ্ন চার উপজেলায়
চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় অন্তত তিন হাজার বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, চালা উড়ে গেছে প্রায় ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে উপড়ে পড়া একটি গাছের চাপায় নিহত হয়েছেন এক ব্যক্তি। চকরিয়ায় একটি সেতু ধসে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে পেকুয়া উপজেলায় প্রাথমিকভাবে অন্তত এক হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এই দুই উপজেলায়ও গতকাল পর্যন্ত ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ৪৪০ বান্ডিল টিন ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। তবে রাত সাড়ে আটটার দিকে ১১ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার নগদ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব ত্রাণ বিতরণের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
মহেশখালী উপজেলার একটি পৌরসভার ও আটটি ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে আরও ২৫ হাজার ঘর। পল্লী বিদ্যুতের অন্তত ৩৫টি খুঁটি ভেঙে গেছে। মঙ্গলবার বিকেল থেকে উপজেলার পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন এই উপজেলার একটি পৌরসভার ও আটটি ইউনিয়নের অন্তত ৭০ হাজার গ্রাহক।
গতকাল বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সাইরার গেইল, নয়াপাড়া, মাঝের গেইল, রাজঘাট ও ষাইটপাড়া এলাকায় কয়েক শ কাঁচা ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
মাতারবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া এলাকায় বিধ্বস্ত বাড়ির সামনে বসে ছিলেন গৃহিণী খাত বানু (৪৫)। তাঁর বসতঘরটি ভেঙে গেছে। এখন নতুন করে ঘর নির্মাণের সামর্থ্য নেই দিনমজুর স্বামী ছৈয়দ মিয়ার। গতকাল পর্যন্ত এই পরিবারটিসহ উপজেলার উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি।
কুতুবদিয়া উপজেলারও ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ৬০০ ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারেও ত্রাণসহায়তা পৌঁছেনি। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই উপকূলীয় কয়েকটি গ্রামের হাজারো মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছিল। এ কারণে প্রাণহানি হয়নি। তবে গাছপালা ও উড়তে থাকা ঘরের টিনের আঘাতে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেল থেকে দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বাঁশখালী-সাতকানিয়ায় তিনজনের মৃত্যু
কক্সবাজারের পর চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় গাছ উপড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি। এর মধ্যে ২৮৩টি বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় বাঁশখালীতে দুজনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সরল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কবির আহমেদের স্ত্রী মমতাজ বেগম (৮০) ও কাথরিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মানিক পাঠান এলাকার মমতাজ আহমেদ (৬৯)।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছ ভেঙে পড়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপড়ে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই।
উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এম সালাউদ্দিন কামাল বলেন, ‘আমি এলাকার ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাঠিয়েছি। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো ত্রাণসহায়তা পাইনি।’
জানতে চাইলে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম চলবে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় টিনের ঘরে গাছচাপা পড়ে এক নারী নিহত হয়েছেন। খাগরিয়া ইউনিয়নের মাঝেরপাড়া এলাকায় একটি টিনের ঘরে গাছচাপা পড়ে বকুমা খাতুন নামের এক বৃদ্ধ নারী নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম বকুমা খাতুন (৬৫)।
[প্রতিবেদন তৈরির তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার, প্রতিনিধি, মহেশখালী, চকরিয়া, আনোয়ারা ও সাতকানিয়া]