‘স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট চাইতে গেলে ঘাড় ধরে বের করে দেবেন’
নওগাঁ-৩ (বদলগাছি-মহাদেবপুর) আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার ও প্রয়াত সংসদ সদস্য আকরাম হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী মাহফুজা চৌধুরী ওরফে মায়া।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্র ওই দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন বদলগাছি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামছুল আলম খান। তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) উপস্থিতিতে নৌকার প্রার্থীকে জয়ী করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট চাইতে গেলে তাঁদের ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে, পাড়া থেকে বের করে দেবেন।
আজ শনিবার দুপুরে বদলগাছির শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার আয়োজন করে উপজেলা প্রশাসন। ইউএনও তৃপ্তি কণা মণ্ডলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শামছুল আলম খান ওই আহ্বান জানান। উপজেলা চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্যের ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর এমন বক্তব্য নির্বাচনে সহিংসতা উসকে দেবে বলে মনে করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা।
শামছুল আলম এক সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বদলগাছি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, শামছুল আলম বর্তমানে দলের কোনো পদে নেই। বিগত দুই কমিটির আগের কমিটিতে শামছুল আলম কোষাধ্যক্ষ পদে ছিলেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হন।
ভিডিওতে দেখা গেছে, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান বক্তব্য দিচ্ছেন। মঞ্চে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার এফ এম জবির উদ্দিন, ইউএনও তৃপ্তি কণা মণ্ডল, বদলগাছি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডি এম এনামুল হক, বাবলু দেওয়ান বসে আছেন। মঞ্চের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চেয়ারে বসে বক্তব্য শুনছেন।
শামছুল আলম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আসছে ৭ জানুয়ারি। জননেত্রী শেখ হাসিনা যে প্রার্থী দিয়েছেন, সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বদলগাছি-মহাদেবপুরের নৌকার কান্ডারি। আজকে কিন্তু আপনারা জানেন, বর্তমান এমপি সাহেব ছলিম উদ্দিন তরফদার, উনি কিন্তু পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, “নৌকা না পেলে আমি নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করব না।” এই কথা কিন্তু উনি বলে গিয়েছিলেন। আজকে উনি কিন্তু নৌকা না পেয়ে, নৌকার ডিক্লেয়ার হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের আকরাম হোসেন চৌধুরীর মিসেস মায়া চৌধুরীও প্রার্থী হয়েছেন। বলেন আপনারা, এটা কি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট, না মেম্বারের ভোট, না দুটাক এমপি হবে এক জায়গায়। এটা কিন্তু আপনাদের ভাবতে হবে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে শামছুল আলম বলেন, ‘আপনাদের সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁকে প্রার্থী দিয়েছেন, তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য আপনাদের পরিশ্রম করতে হবে। কোনোভাবেই যাতে এই ছলিমের লোকজন মাঠে যেতে না পারে, মায়া চৌধুরীর লোকজন যাতে মাঠে যেতে না পারে। তাঁরা বিভিন্ন পয়সাকড়ির কথা বলতিছে, উনি (ছলিম) ১০ বছরে এমন টাকার মালিক হয়ে গেছেন, মনে হয় গোটা বাংলাদেশ কিনে নেবেন, এই রকম পরিস্থিতি ওনার তৈরি হয়ে গেছে। ওনার লোকজন বলতিছেন, পার ভোট পাঁচ হাজার টাকা লাগলেও তা আমি কিনে নেব। আপনারা বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশের ভবিষ্যৎ, আপনাদের এই পবিত্র ভোট লক্ষ টাকার বিনিময়ে কিন্তু বিক্রি করা যায় না। অখাদ্য প্রার্থীরও কিন্তু ভোট দেওয়া যায় না।’
শামছুল আলম আরও বলেন, ‘আমি আপনাদের মাধ্যমে ওনাকে বলতে চাই, ওনারা দুজন প্রার্থী যদি নির্বাচন থেকে সরে না বসেন, ইনশা আল্লাহ বদলগাছি-মহাদেবপুরের মানুষ ওনাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করবেন, আপনারা নিশ্চিত থাকেন। কারণ, এখানে কিন্তু দুডা এমপি হবে না। বর্তমান এমপি সাহেব যেভাবে হুংকার মারতিছেন, ওনার কর্মীরা যেভাবে হুংকার মারতিছেন, আমি আপনাদের বলতে চাই, আগামী ৭ তারিখে এই নির্বাচনে আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের একটু ভূমিকা নিতে হবে। আপনারা এমনভাবে ভূমিকা নেন, এই দুইটা প্রার্থী যেখানে ভোট চাইতে যাবেন, তাঁকে ঘাড়ে হাত দিয়ে বের করে দেবেন বাড়ি থেকে, পাড়া থেকে। এ কারণে দেবেন যে তাঁরা নৌকার লোক কেন নৌকার বিপক্ষে ভোট চাইতে আসছেন। আজকে পরিষ্কারভাবে বলছি, যদি সচিব সাহেবকে (সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) সংসদ সদস্য না করতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য কলঙ্ক হবে।’
এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদারের মুঠোফোনে কল করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর প্রতিনিধি বদলগাছি সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইউএনও-ওসির উপস্থিতিতে উপজেলা চেয়ারম্যান যেভাবে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া কথা বলেছেন, তাতে নির্বাচনে সহিংসতাকে উসকে দেবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহফুজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে শামছুল আলম খান যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, তা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। আমি বিষয়টি রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাব।’
জানতে চাইলে ইউএনও তৃপ্তি কণা মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সময় মঞ্চে ছিলাম ঠিকই, কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সময় অন্যমনস্ক ছিলাম। এ কারণে উপজেলা চেয়ারম্যান কী বক্তব্য দিয়েছেন, বুঝতে পারিনি। তবে উপজেলা চেয়ারম্যানের বক্তব্যের ভিডিও আমাকে একজন পাঠিয়েছেন। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের চেষ্টা করছি। সেখানে একজন জনপ্রতিনিধির এমন বক্তব্য খুবই দুঃখজনক।’