মাস চারেক আগে বগুড়ার ব্যবসায়ী মিলন হোসেনের সঙ্গে রাম মোহন চন্দ্র বর্মণ নামের এক ব্যক্তির পরিচয় হয়। তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জের (এমটিএফই) সিইও হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর ঘরে বসে অনলাইনে ডলার কামিয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখান।
মিলনকে রাজি করাতে শহরের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় কর্মশালায় ডেকে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং স্থানীয় কার্যালয় ঘুরে দেখান। আস্থা অর্জনে রাম মোহন নিজেই সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে মিলনের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। প্রতিদিন সেই অ্যাকাউন্টে ডলার জমা হতে থাকে। কিছু ডলার ভাঙিয়ে টাকাও তোলেন মিলন।
লোভ পেয়ে বসে মিলন হোসেনের। মাত্র চার মাসে স্ত্রী মার্জিয়া আকতার ছাড়াও নামে-বেনামে ছয়টি অ্যাকাউন্টে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন মিলন। এর মধ্যে একটি অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগ করেন ১০ হাজার ১ ডলার। প্রতিদিন সেই অ্যাকাউন্টে ২১৭ ডলার জমা হতো। সপ্তাহখানেক আগে অ্যাকাউন্টে ঢুকে তিনি আকাশ থেকে পড়েন। এমটিএফইর একটি অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর ১০ হাজার ১ ডলার হাওয়া। এখন বিনিয়োগ করা অর্থ হারিয়ে দিশাহারা মিলন হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মিলন নন, বগুড়ায় তাঁর মতো অন্তত ১০ হাজার মানুষ রাতারাতি ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্নে এমটিএফইয়ে বিনিয়োগ করেন। অনলাইন প্রতারণার জাল পেতে তাঁদের কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও প্রতারক চক্র। চক্রের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হাজারো মানুষ। বগুড়ায় চক্রের হোতা রাম মোহন চন্দ্র বর্মণ (৪৬)। তিনি নিজেকে জয়পুরহাটের বাসিন্দা পরিচয় দিতেন। ভাড়া থাকতেন শহরের চেলোপাড়া এলাকায়।
মঙ্গলবার সকালে শহরের শাপলা মার্কেটে কথা হয় মিলন হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাস চারেক আগে শাপলা মার্কেটের রং ব্যবসায়ী রাজীব মণ্ডলের মাধ্যমে রাম মোহনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি এমটিএফইয়ে বিনিয়োগ করে লাখ লাখ ডলার পাওয়ার কথা জানান। তিনি নিজেই সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। সেখানে ডলার জমতে শুরু করলে তিনি নেশায় পড়েন।
মিলন বলেন, ‘ডলারের নেশায় ব্যবসার পুঁজি ভেঙে ২০১ ডলার জমা দিই। প্রতিদিন ১২ ডলার মুনাফা অনলাইনে যোগ হতো। স্ত্রী ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের নামে ছয়টি অ্যাকাউন্ট খুলি। সব অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের ডলার। লাভের অঙ্ক বেশি হলে ডলার ভাঙাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১০ আগস্ট অনলাইনে ঢুকে দেখি, সব ফাঁকা, অ্যাকাউন্টে কোনো ডলার নেই। পরে এমটিএফইর সাইট বন্ধ দেখি। পরিচিতদের খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সবার অবস্থা আমার মতোই।’
শাপলা মার্কেটের ব্যবসায়ী রাজীব মণ্ডলের মাধ্যমে মিলন পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি অনলাইন একটি গ্রুপের দলনেতা। রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মাধ্যমে ২৮ থেকে ৩০ জন এমটিএফইয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন। মিলনও তাঁদেরই একজন। তিনি বলেন, সিইও রাম মোহনের মাধ্যমে বগুড়ায় এমটিএফইয়ে হাজার হাজার মানুষ বিনিয়োগ করেছেন। প্রতিদিন অ্যাকাউন্টে ডলারও এসেছে। অনেকেই ডলার ভেঙে টাকাও তুলেছেন। এটা যে প্রতারণার ফাঁদ, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেননি।
শাপলা মার্কেটের পাপ্পু মেশিনারিজের মালিক পাপ্পু মিয়াও অন্যদের দেখাদেখি লোভে পড়ে ব্যবসার পুঁজি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ডলার যোগ হতো অ্যাকাউন্টে। এখন অ্যাকাউন্ট থেকে ডলার উধাও। ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে এখন আমার দিশাহারা অবস্থা।’
বিনিয়োগকারীরা জানান, শনি ও রোববার বাদে সপ্তাহের ৫ দিন এমটিএফইর সাইট খোলা থাকত। পাঁচ দিন বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্টে আমানতের অঙ্ক অনুযায়ী ডলার যোগ হতো। শাপলা মার্কেট ছাড়াও শহরের নিউ মার্কেট, হকার্স মার্কেট, কাঁঠালতলা, চুড়িপট্টি, প্রেসপট্টির হাজারো ব্যবসায়ী এমটিএফইর ফাঁদে পা দিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়।
লাপাত্তা মূল হোতা
বগুড়া অঞ্চলে এমটিএফই চক্রের হোতা ছিলেন সিইও পরিচয় দেওয়া রাম মোহন চন্দ্র বর্মণ। এমটিএফইর সাইট বন্ধ হওয়ার পর তিনি লাপাত্তা। তাঁর দুটি মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ। জেলায় ৮ থেকে ১০ জন সিইওর অধীনে ১০ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী ছিলেন বলে বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাম মোহনের বাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের দৌলতপুর গ্রামে। দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা সরত্তম চন্দ্র বর্মণ বলেন, রাম মোহন কৃষক পরিবারের সন্তান। তিনি একসময় এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রায়ই তাঁর বাড়িতে লোকজন পাওনা টাকা চাইতে আসতেন। ২০২১ সালে চাকরির কথা বলে তিনি বগুড়ায় থাকতে শুরু করেন।
আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলোয়ারুজ্জামান তালুকদার বলেন, রাম মোহনের বিরুদ্ধে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠলেও তিনি গ্রামে জমিজমা কেনেননি। এলাকায় কোনো বিনিয়োগও করেননি। তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতারাতি ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করত এমটিএফইর প্রতারক চক্র। দলগতভাবে নির্দিষ্ট ডলার বিনিয়োগ করলেই দলনেতাকে সিইও মর্যাদা দেওয়া হতো। তাঁদের লোভনীয় বেতন দেওয়ার কথা বলা হতো। বগুড়ার তিনমাথা এলাকায় লাখ টাকা ভাড়ার কার্যালয়ও নেওয়া হয়। শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁয় গ্রাহকদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হতো। সেখানে বাহারি সব খাবারের আয়োজন থাকত। বিনিয়োগকারীদের লগ্নি ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে এসব কর্মশালায় আশ্বস্ত করা হতো।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইহান ওলিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনভিত্তিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়ে এখনো থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।