সবাই নিজ নিজ চা-বাগান থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে বড় সড়কে এসেছেন মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানাতে। মৌলভীবাজারের রাজনগরের মাথিউরা চা-বাগান থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে এসেছেন গোলাপি রাজভর (৪৫)। সড়কের পাশে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন। রোদে পোড়া চেহারা। ঘামে জবুথবু ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর। তবে তাঁর কথায় ভেসে এল প্রতিবাদের সুর।
গোলাপি রাজভর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই যে পথে আইছি। এমনি আসি নাই। পেটের জন্য আইছি। আমরা ৩০০ টাকা মজুরি চাই। পরিবার বড়। ১২০ টাকায় চলতে পারি না। ঠিকমতো নিজে খাইতে পারি না। বাচ্চাদের পড়াইতে পারি না। দুই সপ্তাহ ধরি দিনে একটা রুটি খাই। কখনো আধা রুটি খাই।’
গোলাপি রাজভরের সঙ্গে যোগ দেন একই বাগানের শ্রমিক বিদ্যাবতী রাজভর। ৩০০ টাকা মজুরি কেন চাওয়া, জানতে চাইলে ব্যাখ্যা দেন এই নারী চা-শ্রমিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাগানের পঞ্চায়েত, মেম্বারদের বলেছি, আপনারা ৩০০ টাকা যে চাইন (চান), এই টাকায় কি চলব? নেতারা বলছেন, “৫০০ টাকা তো চাইছিলাম। কিন্তু আমরা চাইলাম মালিকও বাঁচব, আমরাও বাঁচব। এর জন্য ৩০০ টাকা চাইছি। কিন্তু এই ৩০০ টাকাই মানছে না।’ আমরার খেত-বাড়ি নাই। মালিকের পাতা ভাঙি, এই দিয়া খাই। মালিক বাগানে পাতার চাষ করে, মাছের চাষ করে, রবারের চাষ করে। আইজ এত দিন রাস্তায় কানরাম (কাঁদতেছি)। মালিক একবারও খোঁজ নেয়নি।’
আজ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে চা-শ্রমিকদের চলমান ৩০০ টাকা মজুরির আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজনগরের রাজনগর চা-বাগান ও মাথিউরা চা-বাগানের কয়েক শ শ্রমিক মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের টেংরা বাজারে অবস্থান নেন। এ সময় কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী শ্রমিক (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাথা ঠিক নাই। খিদা লাগছে। পিয়াস লাগছে। পানি খাইয়া খাইয়া এটা করিয়ার (আন্দোলন করছি)। পেটে আমরার যা হয়, আমরা বুঝিয়ার (বুঝতেছি)। আমরা তো কিনিয়া খাইতাম পারিয়ার (পারছি) না। ১২০ টাকায় আমরার পোষে না। ’
তীব্র রোদের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা শ্রমিকেরা টেংরা বাজারে অবস্থান করেন। এতে সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ঘোষ, বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের রাজনগর চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মন্টু নুনিয়া, মাথিউরা চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুগ্রিম গৌড় প্রমুখ বক্তব্য দেন। পরে বেলা একটার দিকে অবরোধ তুলে নিয়ে তাঁরা মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের ইলাশপুর এলাকায় চলে যান। ইলাশপুর এলাকায় অবস্থানের সময় যেন যান চলাচলে কোনো সমস্যা না হয়, সেটা চা-শ্রমিকেরা নিজেরাই তদারকি করেন।
ইলাশপুরে অবস্থানের সময় শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই মাইকে বক্তব্য দেন। এ সময় শ্রমিকেরা বলেন, আজ রাতের মধ্যে মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা না এলে বৃহস্পতিবার আরও বড় জমায়েত নিয়ে তাঁরা সড়ক অবরোধ করবেন। তবে একপর্যায়ে পঞ্চায়েতের নেতারা সব চা-শ্রমিককে নিজ নিজ বাগানে চলে যাওয়ার কথা বলেন। বেলা দুইটার পর সব চা-শ্রমিক ইলাশপুর ছেড়ে নিজেদের চা-বাগানের দিকে চলে যান।
মাথিউরা চা-শ্রমিকনেতা ও টেংরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সত্য নারায়ণ নাইডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘চা-শ্রমিকেরা এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার অপেক্ষায় আছেন। শ্রমিকেরা এর মাঝখানে আর কাউকে বিশ্বাস করেন না। প্রধানমন্ত্রী যা-ই বলবেন, শ্রমিকেরা মানবেন। একবার হ্যাঁ, একবার না বলে নেতারা (বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের) সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। এখন কেউ কারও কথা শুনছেন না।’
মৌলভীবাজারে আন্দোলনরত চা-শ্রমিকনেতারা বলেন, চলমান আন্দোলন গতিশীল ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য লংলা ভ্যালির ১৩টি চা-বাগানের নেতা আগামীকাল বৃহস্পতিবার বসে পরবর্তী আন্দোলনের পরিকল্পনা ঠিক করবেন। অন্যদিকে রাজনগরের করিমপুর চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটিও রাজনগরের সব চা-বাগানের পঞ্চায়েত নেতাদের নিয়ে আগামীকাল বেলা তিনটায় করিমপুর চা-বাগানে একটি বৈঠক ডেকেছে।