লোকজন ডাকেন ‘হুজুর’, তাঁর দোকানের মিষ্টির নামও ‘হুজুরের রসগোল্লা’
মোজাম্মেল হোসেন হাওলাদারের রসগোল্লা তৈরির অভিজ্ঞতা ৫০ বছরের। দীর্ঘ এই সময়ে নিজস্ব শৈলী ও দক্ষতায় তিনি ধীরে ধীরে বানিয়েছেন এমন এক মিষ্টান্ন, যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। পিরোজপুরের বাসিন্দাদের অনেকে এখন বিদেশ যাওয়ার সময় তাঁর দোকান থেকে স্বজন ও পরিচিতদের জন্য এই রসগোল্লা নিয়ে যান। মোজাম্মেলকে এলাকার সবাই ‘হুজুর’ নামে ডাকেন, তাই মিষ্টিপ্রেমীরা তাঁর দোকানের এই মিষ্টির নাম দিয়েছেন ‘হুজুরের রসগোল্লা’।
মোজাম্মেল হোসেনের দোকানের নাম ভাই ভাই রেস্টুরেন্ট। পিরোজপুর শহরের সিও অফিস এলাকায় এটির অবস্থান। তাঁর দোকানে প্রতিদিন ৩ হাজার পিছ রসগোল্লা ও ২০০ কেজি দই বিক্রি হয়। কয়েক পদের মিষ্টান্ন ও দই তৈরিতে প্রতিদিন প্রয়োজন হয় ৬০০ লিটার দুধ।
পিরোজপুরে দই ও রসগোল্লা দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়নের রেওয়াজ আছে। সুনাম ও ব্যবসায়িক ভাবনা থেকে গুণগত মান বজায় রেখে বহু বছর ধরে এই জেলায় ভালো মানের রসগোল্লা তৈরি হচ্ছে। যাঁরা নিয়মিত মিষ্টি খান তাঁরা জানান, খাঁটি দুধের ছানা ও কম মিষ্টি দিয়ে তৈরি রসগোল্লা মুখে দিলেই স্বাদ পাওয়া যায়। অনন্য স্বাদ ও মানের জন্য হুজুরের রসগোল্লার খ্যাতি জেলাজুড়ে।
মোজাম্মেল হোসেন হাওলাদার ১৯৭৩ সালে রসগোল্লা তৈরি শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে শহরের সিও অফিস এলাকায় মিষ্টির দোকান দেন। মিষ্টির পাশাপাশি দোকানে রুটি, পরোটা ও সবজি বিক্রি করেন তিনি। মোজাম্মেল হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘একসময় আমি নিজেই মিষ্টি তৈরি করতাম। এখন কারিগর মিষ্টি তৈরি করেন। তবে গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য কাজের তদারকি করি।’ তিনি জানান, রসগোল্লা সাধারণত পিস হিসেবে বিক্রি হয়। প্রতিটির দাম ১৫ টাকা। রসগোল্লার পাশাপাশি দই, রসমালাই ও চমচম বিক্রি করেন। দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকার মিষ্টি বিক্রি হয়।
মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে জাকির হোসেন বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আমাদের রসগোল্লা খেতে আসেন। কেউ কেউ রসগোল্লা কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যান। ভারত, ইতালি, সৌদি আরব, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখান থেকে রসগোল্লা কিনে নিয়ে যান অনেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পিরোজপুর সফরের সময়ে তাঁদের আমাদের দোকানের রসগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। আমাদের রসগোল্লার বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স আছে।’
পিরোজপুর পৌরসভার রাজারহাট মহল্লার বাসিন্দা তানজীল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে খাবারের মধ্যে হুজুরের রসগোল্লা থাকে। আমার চাচা ও ফুফু বাড়িতে বেড়ানো শেষে ঢাকা যাওয়ার সময়ে হুজুরের রসগোল্লা কিনে নিয়ে যান। যাঁরা ঢাকার তৈরি রসগোল্লা খান, তাঁরা পিরোজপুরের রসগোল্লা খেলেই স্বাদের পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।’
পিরোজপুর শহরের রসগোল্লার খ্যাতি অনেক আগে থেকে। বর্তমানে হুজুরের মিষ্টি ছাড়াও শহরের দামোদর সেতু এলাকার দুলাল দধি ভান্ডার, স্বর্ণকার পট্টির ঐশী মিষ্টান্ন ভান্ডার, সদর রোডের ডায়মন সুইটস ও সাতক্ষীরা ঘোষের রসগোল্লার সুনাম আছে।
মিষ্টির দোকানগুলোর কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সকালে পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও কাউখালী উপজেলা থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করেন তাঁরা। একেকটি মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন ৫ থেকে ১৫ মণ গরুর দুধ প্রয়োজন হয়। দুধ চুলায় জ্বাল দেওয়া শেষে ঠান্ডা করা হয়। আগের রেখে দেওয়া ছানার পানি ঠান্ডা হওয়া দুধের মধ্যে মিশিয়ে ছানা কাটা হয়। এরপর কাপড়ের মাধ্যমে দুধের পানি থেকে ছানা আলাদা করা হয়। পানি ঝরে গেলে ছানা কিছুটা ঝরঝরে হয়ে ওঠে। এরপর সেই ছানা দিয়ে বানানো গোল গোল মিষ্টি জ্বাল দেওয়া হয় চিনির তৈরি শিরায়। এভাবেই তৈরি হয় নরম আর সুস্বাদু রসগোল্লা।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর পিরোজপুর জেলা শাখার সভাপতি খালিদ আবু প্রথম আলোকে বলেন, পিরোজপুরের রসগোল্লা একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছা করবে। এখানকার মানুষ মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন। অতিথিরা বেড়াতে এলে মিষ্টি নিয়ে আসেন। এলাকায় ঈদ, পার্বণ, বিয়েসহ সব অনুষ্ঠানে অতিথিদের আপ্যায়নে খাবারের সঙ্গে রসগোল্লা ও দই দেওয়ার প্রচলন আছে।