দানের জমিতে সরকারি বরাদ্দে সিলেটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মোমেন ফাউন্ডেশন ভবন
আশপাশে যত জমি আছে, সবই টিলাভূমি। সরকারি রেকর্ডপত্রে যুগ যুগ ধরে এ তথ্যই লিপিবদ্ধ আছে। সবশেষ ভূমি জরিপেও সেটাই উল্লেখ করা। কিন্তু আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেনের নামে ২০ শতক জমি দান করার পরই পাল্টে যায় আশপাশের জমির শ্রেণি। ৬০ বছর কাগজপত্রে থাকা ৭৮৬ শতক ‘টিলা’ শ্রেণির জায়গা মাত্র ২৭ দিনেই হয়ে যায় ‘ভিটা’ ও ‘বাড়ি’।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে এ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ আছে, আইনের তোয়াক্কা না করে দ্রুত পাল্টে দেওয়া হয় জমির শ্রেণি। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে দুই বছর পর আবারও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জমির শ্রেণি আগের অবস্থায় ফেরানো হয়। তবে এর মধ্যেই ওই জায়গার স্থানে স্থানে টিলা কাটা হয়েছে।
সিলেট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেলেন আহমদ সদর উপজেলার বড়শালা মৌজার এই জমি দান করেন। তিনি সিলেট-১ (নগর ও সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মোমেনের স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হেলেন আহমদ প্রভাব খাঁটিয়ে তৎকালীন জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাকে দিয়ে ওই জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে দান করা ওই জায়গায় মোমেন ফাউন্ডেশনের ভবন নির্মাণ করতে তিন দফায় সরকার ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে আব্দুল মোমেনের আধা সরকারি (ডিও) পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ এ বরাদ্দ দেয়। বর্তমানে সেখানে একতলা পর্যন্ত কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
দানের পর বদলে যায় জমির শ্রেণি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেলেন আহমদ ও তাঁর ছেলেদের নামে বড়শালা মৌজায় এসএ খতিয়ানের ৩০৫০ দাগে (বর্তমান দাগ ৬৪০৬) ৮৬ শতাংশ জায়গা আছে। পুরো জায়গা ‘টিলা’ শ্রেণিভুক্ত। হেলেন সেখানকার ২০ শতাংশ জমি মোমেন ফাউন্ডেশনের পক্ষে চেয়ারম্যান সেলিনা মোমেনকে ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট দান করেন। দান করা জমির বাজারমূল্য দলিলে ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেখানো হয়। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এ জমির বাজারমূল্য ৬০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা হওয়ার কথা।
নথিপত্র থেকে জানা গেছে, দান করার আট দিন পর হেলেন ওই জমি সেলিনা মোমেনের নামে পৃথক খতিয়ান প্রস্তুতের জন্য সেটেলমেন্ট কার্যালয়ে আবেদন করেন। পাশাপাশি হেলেন তাঁর একই মৌজার বিএস ৫৮১২ ও ৬৪০১ দাগের ‘টিলা’ ও ‘টিলা বাড়ি’ শ্রেণিভুক্ত প্রায় ১৬২ শতক ভূমিকে ‘বাড়ি বা ভিটা’ শ্রেণিতে পরিবর্তন করার জন্যও আবেদন জানান। এ ছাড়া মালিকের নামের শেষে থাকা ‘আহম্মদ’-এর স্থলে ‘আহমদ’ করে সংশোধনের আবেদনও জানানো হয়। এরপর তৎকালীন জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা মুহাম্মদ ওবায়দুর রহমান বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সদরের সহকারী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরকে (২০২২ সালের ৩০ মে অবসরোত্তর ছুটিতে যান) নির্দেশনা দেন। পাঁচ দিন পর হুমায়ূন তাঁর প্রতিবেদন জমা দেন। এতে তিনি স্থানটি সরেজমিনে ‘উঁচু আবাদি জমি’ হিসেবে প্রত্যক্ষ করে ৫৮১২ ও ৬৪০১ দাগের জায়গা ‘ভিটা’ ও ‘বাড়ি’শ্রেণিতে বদলের পক্ষে যৌক্তিকতা আছে বলে মতামত দেন।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত শুনানি শেষে মুহাম্মদ ওবায়দুর রহমান জায়গার শ্রেণি পরিবর্তনের পাশাপাশি ২০ শতাংশ জায়গা সেলিনার নামে খতিয়ানে রেকর্ড করার নির্দেশনা দেন। একই নির্দেশনায় তিনি ‘আহম্মদ’ নামটি সংশোধনেরও আদেশ দেন।
অভিযোগ আছে, জমির এই শ্রেণি পরিবর্তন করতে গিয়ে জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা যে রায় দিয়েছেন, তাতে অন্য খতিয়ানভুক্ত ভূমিমালিকদের ৬২৪ শতক জায়গারও শ্রেণি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মোট ৭৮৬ শতক জায়গার শ্রেণি পরিবর্তিত হয়। কারণ, একই দাগে একই শ্রেণির ভূমি থাকার বিধান আছে।
এ বিষয়ে মুহাম্মদ ওবায়দুর রহমান ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, চূড়ান্ত যাঁচসমাপ্ত রেকর্ড জমা হওয়ার পরও ১৯৫৪ সালের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ৪২(ক) বিধি অনুযায়ী খতিয়ান ও রেকর্ড সংশোধনের সুযোগ তাঁর হাতে রয়েছে। সে অনুযায়ীই হেলেনের আবেদন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে উল্লেখ করে মুহাম্মদ ওবায়দুর রহমান আরও বলেন, তিনি জানতেন, রায়ে ওই ২০ শতক জমিরই শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু রায়ের কারণে দুটি দাগের সমুদয় ভূমির শ্রেণি পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সেটা আসলে তখন লক্ষ করেননি। তিনি ভুলটি পরবর্তী ধাপে সংশোধন করতে চেষ্টা করবেন।
তবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তবারক হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, কাগজপত্র, খতিয়ান, নকশা পর্যালোচনা করে কোনো প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া গেলেই কেবল ৪২(ক) বিধি অনুযায়ী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা মালিকের নাম ও ঠিকানা সংশোধন করতে পারবেন। কিন্তু কোনোভাবেই শ্রেণি পরিবর্তন কিংবা নতুন নামে খতিয়ান প্রস্তুতের বিষয়টি এ বিধিতে সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা করতে পারেন না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেলিনা মোমেন ও হেলেন আহমদের মুঠোফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন পাওয়া যায়। তবে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে হেলেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁর জায়গাটি বাগান শ্রেণির ছিল। এর নামজারি পর্চাও তাঁর আছে। পরে ভুলবশত কাগজপত্রে টিলা শ্রেণি লেখা হয়েছে। যেহেতু এখন তাঁর জায়গায় সরেজমিন ভিটা ও বাড়ি আছে, তাই ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করেন। শ্রেণি পরিবর্তন করতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীকে জায়গা দান করেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই দিন হেলেন বলেন, ‘বিষয়টি তা নয়। এর আগেও একই এলাকায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় জমি দিয়েছি। সমাজসেবা আমার কাজের অংশ।’
সিলেটের সেটেলমেন্ট কার্যালয় জানিয়েছে, হেলেনের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের প্রায় দুই বছর পর ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা মুহাম্মদ ওবায়দুর রহমান তাঁর আদেশ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করে ‘দ্য কোড অব সিভিল প্রসিডিউর, ১৯০৮’-এর ১৫২ ধারা অনুযায়ী শ্রেণি সংশোধনের অংশটুকু বাতিল করে আগের শ্রেণি পুনর্বহাল করেন।
তবে এভাবে শ্রেণি পুনর্বহালের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবী তবারক হোসেইন। তিনি বলেন, ‘এটিও আইনের ব্যত্যয়। এটা তাঁর (সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা) এখতিয়ারবহির্ভূত। কারণ, দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ১৫২ ধারা অনুযায়ী, দুর্ঘটনাবশত যদি কোনো করণিক বা গাণিতিক ভুল হয়, সেটা আদালত সংশোধন করতে পারবেন। সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা এ সংশোধন করতে পারেন না।’
সরকারি ব্যয়ে ফাউন্ডেশনের ভবন
সরেজমিন দেখা গেছে, হেলেনের যে জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়, এর অধিকাংশই গাছপালাবেষ্টিত টিলার ওপর অবস্থিত। ওই জায়গার স্থানে স্থানে টিলা কাটার চিহ্ন স্পষ্ট। এখানে আবাদি জমির অস্তিত্ব খুব বেশি নেই। এ ছাড়া মোমেন ফাউন্ডেশনকে দান করা অংশটিতে নির্মিতব্য একটি বহুতল ভবনের একতলার কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোমেন ফাউন্ডেশনের ভবন নির্মাণের জন্য সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সিলেট সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর আগে একই কাজের জন্য সিলেট জেলা পরিষদকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯০ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭০ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
সিলেট জেলা পরিষদের বরাদ্দ করা টাকায় পাইলিং; বেজ নির্মাণ; প্রোটেকশন ওয়াল; নলকূপ, সেফপি ট্যাংক ও ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপন; পানির মোটর লাগানো; বেজমেন্টের কলাম, স্ল্যাব ও বিম নির্মাণ; প্রথম তলার বিম ও ছাদ নির্মাণ এবং বিদ্যুতের কাজ শেষ করে। চলতি অর্থবছরে সিটি করপোরেশন ভবন নির্মাণে তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু করে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন সেখানে থাকা রডসহ ভবন নির্মাণের যাবতীয় উপকরণ লুট হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এ কাজ বন্ধ রেখেছেন বলে সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে।
ভবন নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ভবন নির্মাণের আগে ওই স্থানে যাওয়ার জন্য কোনো রাস্তা ছিল না। এটি বিবেচনায় নিয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ওই স্থানে যাতায়াতের জন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাকা রাস্তা নির্মাণ করে দেয়। তবে কত টাকা দিয়ে কোন অর্থবছরে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়, সেটি জানা যায়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম) বলেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীকে ঢাল বানিয়ে কিংবা তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় হেলেন জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করেন। সেলিনা মোমেনও দায় এড়াতে পারেন না। মূলত তাঁকে জায়গা দানের পরই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জায়গার শ্রেণি ও রেকর্ড পরিবর্তিত হয়েছে। বদলানো এবং পুনর্বহাল—দুটোই আইনের ব্যত্যয়। জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেই ভবিষ্যতে এমন অপরাধ থেকে অনেকে বিরত থাকবেন।