গ্রামীণ পাকা সড়কের দুপাশে গাছের সারি। ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, চায়ের দোকান, বসতি, স্কুল—এসব রেখে পথ এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দূরদূরান্তে। সে পথ ধরে যেতেই গোমড়ামুখো আকাশে ঝলমল করে ওঠে মিনারে ঘেরা গম্বুজ। তাতে কয়েকটি পায়রা ঘাড় বাঁকিয়ে আয়েশ করে পিঠ-পাখনার পালক খুঁটে চলছে চঞ্চু দিয়ে। মাইকে আজানের ধ্বনিতে একটি-দুটি করে উড়ে উঠল ঝাঁক ধরেই।
দৃশ্যটি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদের। চুন, সুরকি, ইটের তৈরি এই মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে ২৪৪ বছর ধরে। পুরো মসজিদটির ভেতরে ও বাইরে নানা লতাপাতা ও ফুলের নকশা আছে। দৃষ্টিনন্দন হওয়ার কারণে বহু মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন। মসজিদটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ।
জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখে আছে একটি তোরণ। তোরণের নির্মাণশৈলীও অপূর্ব। সেটির সামনে দাঁড়ালেই নজরে পড়ে মসজিদটি। মসজিদের উপরে তিনটি গম্বুজ। নির্মাণের সময় ছাদে ১৬টি বিভিন্ন নকশার মিনার ছিল। তবে ১৯৬৫ সালে মসজিদের ১১টি মিনার ভেঙে পড়ে। সেসময় জমিদার বাড়ির লোকজন সেসব মিনার সংস্কার করেন। তবে তিনটি সম্পূর্ণ আর একটি মিনারের অর্ধেক অংশ এখনো ভাঙা অবস্থায় আছে। ছাদের প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৩৫ ফুট। গম্বুজ আর মিনার মসজিদটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যান্য মসজিদে সচরাচর এত মিনার দেখা যায় না।
মসজিদটিতে ঘুরে দেখা গেছে, এটি চার অংশে ভাগ করা। চার থামের ওপর ছাদবিশিষ্ট প্রবেশপথ, মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদসহ বারান্দা ও উপরিভাগ উন্মুক্ত। প্রবেশ পথে চার থামের ওপর ছাদ বিশিষ্ট মূল দরজা। ছাদের চার কোনায় আছে নকশা করা চারটি ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার। খিলান আকারের প্রবেশপথের সিঁড়ি বেয়ে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।
বাইরের দিক থেকে পরিমাপ করা মূল কক্ষ ও ছাদসহ বারান্দাটি ৪৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৯ ফুট প্রস্থের। মূল কক্ষে প্রবেশের জন্য আছে তিনটি দরজা। দুপাশে দুটি করে জানালা ও কুলঙ্গি আছে। কক্ষের কোণগুলো তিন থামবিশিষ্ট। কক্ষের উভয় পাশে ঢালু তোরণ আকৃতির দুটি অতিরিক্ত স্ফীত অংশ সংযুক্ত হওয়ায় অলংকরণ বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে নতুনত্ব। জানালা ও দরজা জুড়ে রয়েছে লতাপাতার মাঝে ফুলের নকশা। মিহরাবের ফ্রেমেও রয়েছে একই নকশা।
ছাদসহ বারান্দায় রয়েছে খিলানাকৃতির পাঁচটি পথ। প্রতিটি পথে থামের ওপর অর্ধবৃত্ত আকারে কারুকাজ করা। শেষপ্রান্তের থামগুলো উঠে গেছে ছাদের ওপরের মিনার ধরে। মসজিদের মূল ভবনের সামনে রয়েছে একটি আয়তাকার পাকা জায়গা। জায়গাটি অর্ধ প্রাচীরে ঘেরা। প্রাচীরের চারপাশে রয়েছে চারটি মিনার। সেটাও দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে সাজানো।
সরেজমিনে দেখা গেল, মসজিদের সাদা রঙের মিনার ও গম্বুজগুলো রোদে ঝলমল করছে। কয়েকজন শিশু মসজিদের সামনে ক্রিকেট খেলছিল। পাশে একটি বৈঠক ঘর। সেখানে চেয়ার, টেবিল, চৌকি আর বেঞ্চ পাতা। মসজিদের দেয়ালে নোনা ধরেছে। কোথাও কোথাও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের তাজপুর পরগনার জমিদারবাড়ি থেকে রওশন আলী নামে এক ব্যক্তি এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তাঁরই বংশধররা পরবর্তীতে এখানে জমিদারি পান। ১৮৬২ সালে রওশন আলী জমিদারবাড়ির ভিত্তি স্থাপন করেন। বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৮৬৭ সালে তিনি মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু মসজিদের ব্যয়বহুল নির্মাণকাজ শেষ হলেও জমিদার বাড়িটির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়।
তবে জমিদারের নবম পুরুষ আবেদুর রহমান চৌধুরী এ তথ্য সঠিক নয় দাবি করে মসজিদ নির্মাণের পটভূমির বর্ণনা দেন। তাঁর ভাষ্য মতে, আগে এই এলাকাটির নাম ছিল বসন্তনগর। ১৭৬৫ সালের দিকে আব্দুল হালিম নামে এক ব্যক্তি কাপড়ের ব্যবসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ থানার তাজপুর থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরে ভারতের বর্ধমানের জমিদার লালামুক্তি প্রসাদ নন্দের কাছ থেকে জমিদারি কিনে নেন আব্দুল হালিম। ১৭৭০ সালে তাঁকে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরপরই আব্দুল হালিম চৌধুরী জমিদার বাড়ি নির্মাণের কাজে হাত দেন। এ কাজের পাশাপাশি আব্দুল হালিম চৌধুরী ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ থেকে মিস্ত্রি এনে জমিদার বাড়ির পাশেই ১৭৮০ সালে একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। মসজিদের কাজ শেষ না হতেই আব্দুল হালিম চৌধুরী মারা যান। মৃত্যুর পর সেই জমিদারি পান তাঁর ছেলে রওশন আলী চৌধুরী। কিন্তু তিনিও মারা গেলে তাঁর ছেলে জামাল উদ্দীন চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব নেন। তিনিও মারা গেলে জামাল উদ্দীন চৌধুরীর ছেলে নুনু মোহাম্মদ চৌধুরী ১৮০১ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। তবে মসজিদ নির্মাণে বিপুল পরিমাণ খরচ করতে গিয়ে জমিদার বাড়িটির নির্মাণকাজ অসমাপ্ত থেকে যায়।
প্রাচীন এই মসজিদটি এখন পরিচালিত হচ্ছে একটি কমিটির মাধ্যমে। কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তিনি জানালেন, জামালপুরের জমিদারবাড়ি মসজিদটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ। কিন্তু সরকার এর কোনো দেখভাল করে না। এমনকি সরকারি কোনো সাইনবোর্ডও নেই। জমিদার বাড়ির লোকজনই বহুবার এই মসজিদের সংস্কার কাজ করেছেন। সম্প্রতি মসজিদের মেঝেতে টাইলস লাগানো হয়েছে। রং করা হয়েছে দেয়ালে।