রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে বই চুরিতে শাস্তি হতো, এখন নির্যাতনেও নয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ফাইল ছবি

চাঁদার দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার হলে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সামছুল ইসলামকে। মারধরে তাঁর কানের পর্দা ফেটে যায়। নির্যাতনের কথা কাউকে জানালে তাঁকে বুয়েট ছাত্র আবরারের মতো ‘মেরে ফেলার’ হুমকিও দেওয়া হয়।

এ ঘটনা গত বছরের আগস্টের। অভিযোগ উঠেছিল হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহার বিরুদ্ধে। ঘটনাটি তদন্তে কমিটি হয়েছিল। কমিটি নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছিল। কিন্তু ভাস্কর সাহার কিছুই হয়নি। তিনি এখনো দাপটের সঙ্গে হলে থাকছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অপরাধের অভিযোগ উঠলে উপাচার্য তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করতে পারেন। এরপর তদন্ত কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে আজীবন অথবা বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার এবং অন্য শাস্তি দিতে পারে।

আরও পড়ুন

এই কমিটির সভা প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার হওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৪ বছরে শৃঙ্খলা কমিটির মাত্র দুটি সভা হয়েছে—২০১১ ও ২০১৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করে জানা গেছে, ওই দুই সভায় চার জনের শাস্তি হয়। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিককালে যাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, তাঁরা মূলত ছাত্রলীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই। অথচ একসময় বই চুরির মতো অপরাধেও কড়া শাস্তি হতো।

যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির একটি সভা হয়েছিল ২০০১ সালের ২১ আগস্ট। ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই চুরির অপরাধে তিন শিক্ষার্থীর শাস্তি হয়। এর মধ্যে একজনের এক বছরের পরীক্ষা বাতিল ও এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বাকি দুজনকে তিন হাজার করে টাকা জরিমানা করা হয়। একই সভায় শিক্ষককে টেলিফোনে বিরক্ত করা এবং প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

শৃঙ্খলা কমিটির ওই সভায় শুধু শাস্তি দেওয়া নয়, শাস্তির কথা ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর স্বজনদের জানানো এবং পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে প্রক্টরের দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

আর এখন...

এখন ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আসন–বাণিজ্যের ঘটনায়ও বিচার হয় না। ২০২১ ও ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটেছে ৩০টির বেশি। অন্তত ২৫টি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। ১৩টি ঘটনা ঘিরে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৮টির বেশি। তবে কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

যেমন গত বছরের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয় আল-আমিন নামের এক শিক্ষার্থীকে। তাঁর অভিযোগ, নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের দুই নেতা তাঁর ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকাও তুলে নেন। কিন্তু তিনি কোনো বিচার পাননি।

অবশ্য একটি ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এড়িয়ে যেতে পারেনি। সেটি হলো, ২০১৪ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীরের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া এবং প্রকৌশল দপ্তরের পিয়ন সুমন ও প্রহরী আবুল কাশেমকে মারধর করা। শৃঙ্খলা কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ওই ঘটনায় ২০১৬ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন (তুহিন), সহসভাপতি তন্ময় আনন্দ (অভি) এবং শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখা কমিটির সভাপতি মামুন-অর-রশিদকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।

এটি ছিল ১৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির দুটি বৈঠকের একটি। ওই সময় শৃঙ্খলা কমিটিতে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনাটির ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল।

আরও পড়ুন

ঘটনার কিছুদিন আগে মূল অভিযুক্ত তৌহিদ আল হোসেনের অস্ত্র হাতে গুলি ছোড়ার ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি পদ্মা সেতুর জন্য টাকা তুলে ভাগাভাগি করেছিলেন। এ নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিল। এরপর প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করেছিলেন। ফলে প্রশাসনের শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

গত ১৪ বছরে শৃঙ্খলা কমিটির দুটি সভার আরেকটি হয়েছিল ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর। ওই সভায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে শাস্তি হিসেবে দুই বছর পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বিভাগের এক শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন।

সভা ডেকেও স্থগিত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির এখনকার সভাপতি উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। এই কমিটিতে সদস্যসচিব হিসেবে রয়েছেন প্রক্টর আসাবুল হক। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে দুজন সহ-উপাচার্য, একজন ডিন ও একজন ছাত্র উপদেষ্টা রয়েছেন। এখনকার কমিটিতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের অনুসারী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের রাজনীতি করে আসা।

বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ–উপাচার্য মো. সুলতান-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সভা প্রতি ছয় মাসে একটি হওয়ার কথা। তবে প্রয়োজনে আরও বেশি হতে পারে। আর উপাচার্য চাইলে কমিটির সদস্যসংখ্যা বাড়াতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি শৃঙ্খলা কমিটির একটি সভা ডাকা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। তবে পরে সভাটি স্থগিত হয়ে যায়। ওই সভায় ১৩টি অভিযোগ ও প্রতিবেদন ওঠার কথা ছিল। প্রক্টর আসাবুল হক জানান, তাঁদের কাছে ১৩-১৫টি অভিযোগ আছে। এগুলো শৃঙ্খলা কমিটিতে উঠবে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, সময়স্বল্পতার কারণে সভাটি করা সম্ভব হয়নি। শিগগিরই সভাটি হবে।

শাস্তি কেন হয় না

শিক্ষকদের কেউ বলছেন, শিক্ষকেরা প্রশাসনের বড় পদ পান ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষক সংগঠনের রাজনীতি করে। ছাত্রলীগ আবার ক্ষমতাসীন দলেরই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। তাই তাদের অপরাধের শাস্তি হয় না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, হলগুলোতে নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। শাস্তি না হওয়ায় ঘটনা আরও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বেশির ভাগ ঘটনা ঘটাচ্ছে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন।

তাদের শাস্তি হয় না। কারণ, উপাচার্য নিয়োগ হয় ক্যাম্পাসের প্রতিনিধিদের মতামত ছাড়াই সরকারের পক্ষ থেকে। এতে ওই উপাচার্য সরকার কিংবা সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে যাওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেন।