লিবিয়ায় নির্যাতনে তরুণের মৃত্যু, লাশ নৌকায় পাঠানো হয় ইতালি
মাদারীপুরের তরুণ সাইদুল ব্যাপারী (২৩) ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালাল ধরেন। দালালের সঙ্গে চুক্তি ছিল, যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে পৌঁছে দেবেন। শেষ পর্যন্ত সাইদুলকে জীবিত নয়, দালালের নির্যাতনে মারা যাওয়ার পরে মৃত অবস্থায় নৌকায় ইতালি পাঠানো হয়েছে।
নিহত সাইদুল মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের খাটোপাড়া গ্রামের শহিদুল ব্যাপারীর ছেলে। সাইদুলের মৃত্যুর বিষয়টি তাঁর পরিবারের সদস্যরা আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন। তবে মরদেহের কোনো সন্ধান জানতে পারেননি তাঁরা।
স্বজন ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, উন্নত জীবনের আশায় গত বছরের আগস্টের শুরুতে স্থানীয় দালাল শিপন খানের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশ ছাড়েন সাইদুল। তাঁকে ঢাকা থেকে সরাসরি দুবাই নেওয়া হয়। দুবাই শহরে কয়েক দিন রাখার পরে সাইদুলকে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরেই সেখানে মাফিয়া (দালাল চক্র) সাইদুলকে জিম্মি করে একটি বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়। প্রায় এক সপ্তাহ পরে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের মাধ্যমে সাইদুলকে মুক্ত করে তাঁর পরিবার। এরপর বাংলাদেশি এক দালালের মাধ্যমে সাইদুলের পরিবার আরও ১৬ লাখ টাকায় ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ করেন। চুক্তিতে বলা হয়, যেভাবেই হোক সাইদুলকে ইতালিতে পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে মাফিয়াদের নির্যাতন সইতে না পেরে ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় মারা যান সাইদুল। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি মরদেহ ট্রলারে করে অন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে ইতালিতে পাঠানো হয়। ফোনে সাইদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তাঁর পরিবার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের মাধ্যমে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সাইদুলের পরিবার জানতে পারে সাইদুল ইতালি পৌঁছানোর আগেই মারা গেছেন। তাঁর লাশ দালালেরা নৌকায় করে অন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে ইতালিতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার অন্যতম একটি পথ লিবিয়া। এ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় ছোট ছোট নৌকা। এসব নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয়। প্রতিবছর এ পথে যাত্রা করতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী। এ জন্য এ কাজে দালালেরা চালু করেছেন ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় যত দিন লাগুক, অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ইতালি জীবিত পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে টাকা নেন দালালেরা। সে পর্যন্ত একজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর থাকা, খাওয়া, বিমানভাড়া-সবকিছুই বহন করে দালাল চক্র।
সাইদুলের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের লালু খানের ছেলে শিপন খান। বাংলাদেশ থেকে তরুণদের লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে মুক্তিপণের অর্থ আদায় করেন তিনি। পরে মাফিয়াদের নির্যাতনে মৃত্যু হলে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে লাশ নৌকায় করে ইতালিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।
সাইদুলের বাবা শহিদুল ব্যাপারী বলেন, ‘দালাল শিপনের মাধ্যমে ছেলেরে ইতালিতে পাঠাইতে চাইছিলাম। ধরা খাওয়ার পরে লিবিয়ার দালাল আমার ছেলেকে বন্দী করে রাখে। এরপর নির্যাতন করে ধাপে ধাপে ৪০ লাখ টাকা নেয়। সাইদুলকে তিন বেলা ঠিকমতো খাইতেও দিত না। আমার পোলাডা অনেক কষ্ট করছে। তবুও ওর স্বপ্ন ছিল ইতালি যাইবে। তাই দালালের কথামতো ভিটেমাটি যা ছিল, সব বেচে দিয়ে ছেলেকে ইতালি নিতে দালালের সঙ্গে “বডি কন্ট্রাক্ট” করি। কিন্তু দালাল আমাগো ভুল বুঝাইছে। এত দিন খালি সাইদুল বাঁইচা আছে, বাঁইচা আছে বলত। এখন যখন আমরা সত্য ঘটনা জানছি, তারপর থেকেই দালালের খবর পাইতাছি না। আমার ছেলেকে হত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চাই।’
এদিকে ঘটনাটি টাকা দিয়ে মীমাংসার জন্য স্থানীয় মাতবরেরা চাপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন শহিদুল ব্যাপারী।
সাইদুলের চাচা সাহাবুদ্দিন ব্যাপারী বলেন, মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা হয়ে, চড়া সুদে টাকা এনে তাঁর ভাইয়ের পরিবার দালালের হাতে তুলে দিছে। কয়েক দফায় এই টাকা নিজেই নিতে আসেন শিপন খান। ছেলেকে ইতালিতে পাঠানোর স্বপ্নে এখন পুরো পরিবারটি নিঃস্ব। এ ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত দালাল শিপন খান বলেন, ঘটনাটির মীমাংসা হয়েছে। নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে বলার কিছু নেই। লিবিয়া দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে একটি দুর্ঘটনায় সাইদুলের মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি করেন শিপন খান।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোকছেদুর রহমান বলেন, লিবিয়ায় নির্যাতনে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর পরিবারকে থানায় এসে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। তাঁরা লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।