আলো ছড়াচ্ছে ইকবালের ‘গাছতলার বিদ্যালয়’
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ থেকে পানির স্রোতে মিরসরাই উপকূলে ভেসে আসে জীবিত-মৃত শত শত মানুষ। বেঁচে যাওয়া মানুষেরা সময়ের ব্যবধানে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের দুই পাশে গড়ে তোলেন জনবসতি। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় দরিদ্র লোকজনও সরকারি এই জায়গায় নিজেদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে নেন । সাগরে মাছ ধরে আর বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে এসব মানুষের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা হলেও শিক্ষার আলোবঞ্চিত ছিল তাঁদের ঘরে থাকা শিশুরা। এক যুগ আগে শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত অসহায় এসব শিশুর জন্য উন্মুক্ত স্থানে ‘সোনালি স্বপ্ন’ নামের একটি অস্থায়ী বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করেন ইকবাল হোসেন নামের এক যুবক। উপকূলের বেড়িবাঁধ এলাকায় নারকেলগাছের ছায়ায় পরিচালিত বিদ্যালয়টি পরিচিত হয়ে ওঠে ‘গাছতলার বিদ্যালয়’ নামে। ইকবালের সেই বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক।
উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থিত বিদ্যালয়টি। সম্প্রতি সরেজমিনে বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের পাশে নারকেলগাছের নিচে ঘাসের ওপর বই নিয়ে পড়তে বসেছে ৫০-৬০ জন শিশু। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বই হাতে পড়াচ্ছিলেন ইকবাল হোসেন। কথা হয় শিক্ষক ইকবালের সঙ্গে। এমন ব্যতিক্রমী বিদ্যালয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেন তিনি।
ইকবাল জানান, ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স শেষ করার পর চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স পাস করেন তিনি। ছয় বছর ধরে স্থানীয় বদিউল আলম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের একটি নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করে আসছেন তিনি। ২০১৩ সালে জানুয়ারি মাসের এক বিকেলে সাহেরখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান ইকবাল। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপকূলীয় এলাকার নানা দৃশ্য তাঁকে যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি বেড়িবাঁধের শিশুদের দেখে তাঁর মন বিষাদে ভরে যায়। তিনি দেখতে পান, লাকড়ির বোঝা মাথায় করে বাড়ি ফিরছে শিশুরা।
আশপাশে ঘুরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, জীর্ণশীর্ণ শরীর আর উষ্কখুষ্ক চুলের এসব শিশুর কেউই বিদ্যালয়ে যায় না। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে জানান, গজারিয়া বেড়িবাঁধ, সাহেরখালী বেড়িবাঁধ, ডোমখালী বেড়িবাঁধ ও সন্দ্বীপপাড়া মিলে এলাকাটিতে অন্তত কয়েক হাজার দরিদ্র মানুষের বাস। এ বসতিগুলো থেকে সবচেয়ে কাছে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়, সেটির দূরত্বও প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। দূরত্ব আর মূল বসতির মানুষের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ গড়ে না ওঠায় শিক্ষার আলোবঞ্চিত থেকে যায় এলাকার শিশুরা।
ইকবাল বলেন, সেদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আঁধার নামলে বাড়ি ফেরেন তিনি। তবে রাতে ঘুমাতে গেলে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শিক্ষাবঞ্চিত শিশুগুলোর মুখ। ইকবাল সে রাতেই সিদ্ধান্ত নেন এসব শিশুর জন্য কিছু করার। যেই ভাবনা সেই কাজ। এরপর নিয়মিত বেড়িবাঁধ এলাকায় যাতায়াত শুরু করেন। কথা বলতে থাকেন শিশুগুলোর পরিবারের অভিভাবকদেরর সঙ্গে। ধীরে ধীরে তাঁদের আগ্রহী করে তোলেন শিশুদের পড়াশোনায়।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ১৪ জন শিশু নিয়ে বেড়িবাঁধ এলাকায় অস্থায়ী বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয় বলে জানান ইকবাল। তিনি বলেন, অবকাঠামো না থাকায় গাছতলায় ঘাসের ওপর বসে পড়ালেখা করে শিশুরা। শুক্র ও শনিবার সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস নেওয়া হয়। বিদ্যালয়টির পঠনপাঠনের পদ্ধতি বেশ আলাদা। মূলত শিশুদের বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পড়তে ও লিখতে শিখিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী করা হয়। একই সঙ্গে বিদ্যালয়মুখী করতে শিশুদের উদ্বুদ্ধ করা, প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সহায়তা, পোশাক ও শিক্ষাসামগ্রীর ব্যবস্থাও করা হয় তাঁর বিদ্যালয় থেকে। এ কাজে ইকবাল সহায়তা পান স্থানীয় শিক্ষা অনুরাগী ও সচেতন নানা সংগঠন থেকে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১১ বছরে সাহেরখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় ইকবালের এ বিদ্যালয় বদলে দিয়েছে শিশুদের চলন-বলন। ১৪ জন থেকে শুরু করে অস্থায়ী এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এখন শতাধিক। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই এখন স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাচ্ছে তারা। অভিভাবকেরা ইকবালের বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সচেতন হয়েছেন বাল্যবিবাহ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে।
ইকবালের স্বপ্ন
এ বিদ্যালয় নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন, এমন প্রশ্নে ইকবাল হোসেন বলেন, স্থায়ী কোনো অবকাঠামো না থাকায় বর্ষাকালে প্রায় সময় বন্ধ রাখতে হয় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। আর সমুদ্রের একেবারে কাছে হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় বিপন্ন হয়ে ওঠে বেড়িবাঁধ এলাকার মানুষের জীবন। তাই এলাকায় একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় সেটি যেমন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, তেমনি সেখানে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমও চালানো যাবে নির্বিঘ্নে। বিদ্যালয়টির স্থায়ী স্থাপনা হবে, সেটিই স্বপ্ন।
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, পড়াশোনা করে তারা মানুষের মতো মানুষ হচ্ছে, এমনটা দেখলেই আমার সুখ। আমার স্ত্রী তানজিনা আক্তার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ কাজে তার উৎসাহ আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’
অভিভাবকেরা যা বলছেন
সাহেরখালী গজারিয়া বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ইকবাল স্যারের বিদ্যালয়ে পড়া শেষে আমার এক ছেলে স্থানীয় গজারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে ও মেয়ে সাহেরখালী উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। ইকবাল স্যারের বিদ্যালয়টি না থাকলে এটি কখনোই সম্ভব হতো না। পড়ানোর পাশাপাশি শিশুদের ঈদে নতুন জামা, শিক্ষাসামগ্রী ও স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা পরামর্শ দেন স্যার। তাঁর উৎসাহ পেয়ে এখন আমি আমার দুই ছেলে-মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা মইনুল হোসেন বলেন, ‘সাহেরখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় ইকবাল হোসেনের স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত বিদ্যালয়টি এলাকায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইকবালের অক্লান্ত শ্রমে এলাকার শিশুরা এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে। নানাভাবে আমরাও তাঁর এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি। এখন সেখানে স্থায়ীভাবে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি।’
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের গজারিয়া এলাকায় উপকূলীয় অঞ্চলে স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত ইকবাল হোসেনের অস্থায়ী বিদ্যালয়টি সম্পর্কে জানি। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে তাঁর এ দায়িত্বশীল উদ্যোগ প্রশংসনীয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের শীতবস্ত্র ও শিক্ষাসামগ্রী দিয়েছি আমরা। সেখানে স্থায়ীভাবে একটি বিদ্যালয় করতে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হবে।’