সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজের নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর সময় আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। কিন্তু বর্ধিত সময়েও পুরো কাজ শেষ হয়নি। এবার জেলার ৫৮টি হাওরে ১ হাজার ৬৩টি প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ হচ্ছে। এতে প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। কাজে রয়েছে নানা অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ। হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন হাওরে কৃষকদের পক্ষে সোচ্চার ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বর্ধিত সময়ও শেষ, কিন্তু ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ হয়নি কেন?
বিজন সেন রায়: এবার যে এই পরিস্থিতি হবে, সেটা আমরা শুরুতেই বুঝেছি। কারণ, এবার সংশ্লিষ্টরা কাজের চেয়ে প্রকল্প ও আর বরাদ্দ বাড়ানো নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন বেশি। যেখানে কাজ শুরুর কথা ১৫ ডিসেম্বর, সেখানে এক সপ্তাহ আগেও কিছু কিছু জায়গায় কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে বিলম্ব এবং কাজে সঠিক তদারকির অভাবে এবারও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কেন নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায় না?
বিজন সেন রায়: আসলে নীতিমালা অনুযায়ী কাজ না হলে সমস্যা তো হবেই। নভেম্বর মাসের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ ও পিআইসি গঠন শেষ করার কথা। এই কাজটি সঠিকভাবে হয় না। সংশ্লিষ্টরা নানা অজুহাত দেখিয়ে এই কাজে বিলম্ব করেন। গণশুনানি করে প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠন করার কথা থাকলেও সেটি কখনোই হয় না। এই কাজগুলো ঠিকমতো করলে কাজে অনিয়ম-গাফিলতির সুযোগ কম থাকত। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রকল্প নিয়েও একধরনের চাপে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। যত বেশি প্রকল্প তত বেশি লাভ, এখন বিষয়টা এ রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলো: এই যে অনিয়ম বা গাফিলতি বলছেন, এসবে কারা যুক্ত?
বিজন সেন রায়: পাউবো ও প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাই প্রকল্প গ্রহণ ও পিআইসি গঠনের কাজ করেন। এই কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি সঠিকভাবে হলে অনিয়মের সুযোগ কম। কিন্তু এটি সঠিকভাবে হয় না। অনেক জায়গায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়। দেখা যায়, অক্ষত বাঁধেও বরাদ্দ দেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পিআইসিতে রাজনৈতিক দলের লোক, স্থানীয় প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে ঢুকে পড়েন। তাঁরাই কাজে গাফিলতি করেন বেশি। আবার শুরুতে তদারকি থাকে কম। যাঁরা প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও তদারকিতে যুক্ত, তাঁদের কারোরই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কাজে অনিয়ম বা গাফিলতির বিষয়টি কীভাবে হয়?
বিজন সেন রায়: গত বছর প্রকল্প ছিল ৭২৭টি। ব্যয় হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। এবার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৬৩টি, প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৪ কোটি টাকা। বন্যার অজুহাত দেখিয়ে এই প্রকল্প ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটা হাস্যকর। সুনামগঞ্জে প্রতিবছরই বন্যা হয়, বাঁধ প্রতিবছরই পানির নিচে যায়। এটা খোঁড়া যুক্তি। আবার এসব প্রকল্পের অনেকগুলোই আছে অপ্রয়োজনীয়। বরাদ্দ ধরা হয়েছে অতিরিক্ত। যেখানে বরাদ্দ পাঁচ লাখ টাকার মাটি লাগবে, সেখানে ধরা হয় ২৫ লাখ টাকা। সরকারের অনেক টাকার অপচয় হয়। যত্রতত্র বাঁধে ক্ষতি হচ্ছে হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশের। আমরা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বিরুদ্ধে সব সময় কথা বলি, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। এখন হাওরে বাঁধ নির্মাণকে ঘিরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এটা ভাঙতে হবে। আমরা এসব বিষয়ের তদন্ত চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি।
প্রথম আলো: সময়মতো বাঁধ না হলে ঝুঁকিটা কী?
বিজন সেন রায়: সুনামগঞ্জের মানুষ বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। জেলার ছোট–বড় ১৫৪টি হাওরে এবার ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এসব জমির ধান অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই বাঁধ দিতে হবে। কিন্তু এই কাজটি হতে হবে নির্ধারিত সময়ে ও সঠিকভাবে। অসময়ে তাড়াহুড়া করে কাজ করলে বাঁধ দুর্বল হয়। বৃষ্টির মধ্যে কাজ করলে বাঁধ টেকসই হয় না। দুর্বল বাঁধ ঢলের পানির প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারে না। বাঁধ যত আগে হবে ততই ভালো। কিন্তু এবারও সেটি হয়নি। কাজটি সময়মতো না হওয়াটাই ফসলের জন্য বড় ঝুঁকি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: প্রতিবছরই বাঁধ নিয়ে কথা হয়, আসলে সমাধানটা কী?
বিজন সেন রায়: সমাধান হলো, নীতিমালা মেনে কাজ করা। কাজে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। প্রকল্প গ্রহণ ও পিআইসি গঠনে অনিয়ম বন্ধ করা। যেসব স্থানে স্থায়ীভাবে কাজ করা যায় সেটি করা। প্রকল্প ও ব্যয় বাড়ানোর ধান্দা থেকে সংশ্লিষ্টদের সরে আসা। শেষ দিকে এসে পিআইসিদের নোটিশ, আটক এসব লোকদেখানো পদক্ষেপ না নিয়ে যাঁরা তদারকিতে আছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা। পিআইসি প্রথাকে বিতর্কিত করার একটা চেষ্টা আছে। একই সঙ্গে বাঁধের সংখ্যা কমানো। হাওর এলাকার নদী ও খালগুলো খনন করা। হাওরে পাহাড়ি ঢলের পানির চাপ কমাতে পারলে অনেক স্থানে বাঁধ দিতে হবে না।