কটু কথায় দমে না যাওয়া সাগরিকা এখন গ্রামবাসীর গর্ব, অন্যদের অনুপ্রেরণা
মেয়ের ফুটবল খেলা নিয়ে গ্রামবাসীর কটূক্তিতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন লিটন আলী ও আনজু বেগম দম্পতি। একসময় মেয়ে সাগরিকাকে মাঠে যেতে বারণও করে দেন তাঁরা। কিন্তু মেয়ের জেদ আর ক্রীড়া সংগঠকদের অনুরোধকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন তাঁরা। এখন সেই সাগরিকাই গোটা গ্রামবাসীর গর্ব।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনালে ‘টস–কাণ্ডের পর’ যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে সেই খেলায় পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে মোসাম্মাৎ সাগরিকার গোলে সমতায় ফেরে। পরে টাইব্রেকারে দুই দলের ১১ করে ২২ খেলোয়াড়ের সবাই বল জালে জড়ান। শেষ পর্যন্ত যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ ও ভারতকে।
সাগরিকাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের রানীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে। রানীশংকৈল-হরিপুর সড়কের বলিদ্বারা এলাকায় চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার চালান লিটন আলী। তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে সাগরিকা ছোট। আর ছেলে মোহাম্মদ সাগর একটি ইটের ভাটায় কাজ করেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সাগরিকাদের ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। প্রতিবেশীরা জানালেন, সাগরিকার মা-বাবা মেয়ের খেলা দেখতে ঢাকায় গিয়েছেন। সাগরিকার ভাই মোহাম্মদ সাগর বাড়িতে একাই আছেন। তিনি কাজে বাইরে গেছেন।
লিটন আলীর চায়ের দোকানে এসে দেখা গেল, দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। দোকানের পাশে মকবুল হোসেনের ডিজিটাল স্কেলে ওজন পরিমাপের ঘর। লিটন আলীর চায়ের দোকানের জায়গাটিও মকবুলের। আর্থিক অবস্থা দেখে লিটনকে তিনি এখানে চায়ের দোকান চালাতে দিয়েছেন। মাসে সামান্য কিছু ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও দিতে পারেন না লিটন। মকবুল হোসেন বলেন, ‘টেলিভিশনে বাংলাদেশের হয়ে লিটনের মেয়ের খেলা দেখে আমার মনে হয়েছে, তাকে জায়গা দিয়ে আমি ঠিক কাজটাই করেছি। সাগরিকা আমাদের গর্ব। তাদের জন্য কিছু করতে পারলে আমাদেরও ভালো লাগবে।’
আবদুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সাগরিকার বড় ভাই সাগর হাজির হন। এসেই দোকানের ঝাঁপ খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কাজের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। সাগর জানান, বৃহস্পতিবার রাতে ফাইনাল খেলা দেখার জন্য এলাকার ছেলেরা বড় পর্দার ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে তিনিও বোনের খেলা দেখেছেন। সাগর বললেন, ‘খেলার শুরুতে আমরা (বাংলাদেশ) যখন গোল খেয়ে বসলাম, তখন মনটা খারাপ হলেও দমে যাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার বোনেরা গোল পরিশোধ করবেই। শেষ পর্যন্ত আমার বোন সাগরিকাই দেশের সম্মান বাঁচাল। ওকে নিয়ে আমি গর্ব করতেই পারি।’
মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে আমরাই কত কথা শুনিয়েছি। এখন মনে হয়, সেটা আমাদের ভুল ছিল। আজ সাগরিকাকে সারা দেশ চেনে।
সাগর, তাঁদের কয়েক প্রতিবেশী ও স্থানীয় রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথায় কথায় উঠে আসে সাগরিকার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প।
ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি সাগরিকার টান ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট দিয়ে ফুটবল খেলা শুরু তাঁর। এরপর রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমির মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণে যোগ দেন সাগরিকা। সে সময় মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে কটূক্তি করতেন গ্রামের অনেকে। তাঁদের কথায় বিরক্ত হয়ে সাগরিকার বাবা লিটন আলী মেয়েকে মাঠে যেতে বারণ করে ঘরে আটকে রাখলেন। এসব উপেক্ষা করে মাঠে চলে যেতেন সাগরিকা। একসময় তাজুল ইসলামের অনুরোধকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হলেন লিটন আর আনজু। ফুটবল অনুশীলনে নামলেন সাগরিকা।
তাজুল ইসলাম জানান, সাগরিকা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাঙাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমি থেকে কয়েক মেয়েকে ভর্তি করাতে বিকেএসপিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সাগরিকা সেখানে গিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। শেষমেশ গ্রামে ফিরে আসেন। এরপর সেই রাঙ্গাটুঙ্গী থেকেই সাগরিকাকে অন্য নারী ফুটবলারদের সঙ্গে দলে ভেড়ায় মেয়েদের ফুটবল লিগের দল এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মেয়েদের লিগে সাগরিকা পাল্লা দিয়েছেন দেশের শীর্ষ নারী ফুটবলারদের সঙ্গে। সেবার সাগরিকা গোল করেছিলেন ১০টি। এরপরই মেয়েদের ফুটবলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তাঁকে নিয়ে আসেন মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলে। সেই থেকে বাংলাদেশের জার্সিতে ফুটবল শুরু সাগরিকার।
সাগরিকার প্রতিবেশী আবদুল কাদের বলেন, ‘মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে আমরাই কত কথা শুনিয়েছি। এখন মনে হয়, সেটা আমাদের ভুল ছিল। আজ সাগরিকাকে সারা দেশ চেনে। তার মাধ্যমে আমাদের এলাকাকেও গোটা দেশ চিনছে।’
সাগরিকাদের সব সময় আগলে রাখেন রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সাগরিকার মধ্যে বিস্ময়কর প্রতিভা রয়েছে। সে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের রত্ন হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর একাডেমির অন্য কিশোরীদেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে সাগরিকা।’
একসময় মেয়েকে খেলতে দিতে না চাওয়া লিটন আলী ও আনজু এখন মেয়ের জন্য গর্ব করেন। মেয়ের খেলা দেখতে ছুটে গিয়েছেন ঢাকায়। তাঁরা গতকাল রাতে ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরতে বাসে ওঠেন। লিটন আলী মুঠোফোনে বলেন, ‘মেয়ের জন্য আজ কত সম্মান পেলাম। মেয়ের জন্য এখন আমাদের অনেক গর্ব হয়। মেয়ের খেলা বন্ধ করতে গিয়ে আমি যে কতটা ভুল করতে গিয়েছিলাম, এখন তা বুঝতে পেরেছি।’ আর আনজু বেগম বলেন, ‘মেয়েটা যেন দেশের জন্য আরও সম্মান বয়ে আনতে পারে, সবার কাছে এই দোয়া চাই।’