বাড়িতে যেতে টাকা চেয়েছিলেন নাজমুল, কিন্তু গেল তাঁর গুলিবিদ্ধ মরদেহ

মেয়ের সঙ্গে নিহত নাজমুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

দরজির কাজ করে সংসার চালাতেন নাজমুল ইসলাম। থাকতেন ঢাকার উত্তরায়। আয়রোজগার বাড়লে স্ত্রীকে বাবার বাড়ি থেকে নিজের ভাড়া বাসায় আনতে চেয়েছিলেন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নাজমুলের কাজ বন্ধ ছিল; রোজগারও হচ্ছিল না। গ্রামের বাড়িতে যেতে গত ৫ আগস্ট দুপুরে তিনি মুঠোফোনে স্ত্রীর কাছে কিছু টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে গিয়ে নাজমুল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

নাজমুল ইসলাম রাজু (৩৯) ময়মনসিংহ নগরের সেহরা মুন্সিবাড়ি এলাকা মৃত নিলু মিয়ার ছেলে। তাঁর মায়ের নাম মোছা. সাজেদা (৫৫)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় ছিলেন নাজমুল। ২০০৫ সালে বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন সংসারের ভার পড়ে নাজমুলের কাঁধে; শুরু করেন দরজির কাজ। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করেন বাবার। ২০১১ সালে তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর মা ও বোনেরা নগরের সুতিয়াখালী এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকেন।

আড়াই বছর আগে বিয়ে করেন নাজমুল ইসলাম। স্ত্রী শিলা আক্তারের (২৩) বাবার বাড়ি ত্রিশাল উপজেলার বৈলর এলাকায়। এই দম্পতির দেড় বছরের একটি মেয়ে আছে।

স্বজনেরা জানান, নাজমুল ইসলাম দরজির কাজ করতেন উত্তরার আজমপুর এলাকায়। সাড়ে তিন বছর আগে ময়মনসিংহ শহরে এসে ঋণ করে নিজে ছোট ব্যবসা দেন। ট্রাউজার বানিয়ে পাইকারি বিক্রি করতেন। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় গত ১০ জুলাই উত্তরার আজমপুর এলাকায় একটি কারখানায় দরজির কাজে যোগ দেন তিনি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আনন্দমিছিলে যান নাজমুল। ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে স্বজনেরা রাতে লাশ নিয়ে যান। ময়নাতদন্ত ছাড়াই ৬ আগস্ট ময়মনসিংহ নগরের কালীবাড়ি গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়।

নিহতের ভোট ভাই রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার (৫ আগস্ট) দিকে ভাইয়ের সহকর্মীরা ফোন করে খবর দেন ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তখন আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। মেসেঞ্জারে একটি ছবি পাঠানোর পর আমরা নিশ্চিত হই। পরে ভাইয়ের সহকর্মীরা রাত সাড়ে ৩টার দিকে লাশ ময়মনসিংহে নিয়ে আসেন। লাশ আনার পর দেখি, বুকের বাঁ দিকে একটি গুলি লেগে পেছন দিকে বেরিয়ে গেছে।’

ওই (নাজমুল) বলেছিল, ‘তুমি বাড়ি থাইক্যা কিছু টাকা পাডাও, আমি বাড়িত আইয়াম। এইনে মাহাজনও নাই, লোকজনও গেছে গা, মেসে খাইবারও পাইতাছি না।’
শিলা আক্তার, নিহত নাজমুল ইসলামের স্ত্রী

শিলা আক্তার বর্তমানে তাঁর বাবার বাড়ি ত্রিশালের বৈলরে আছেন। মুঠোফোনে শিলা আক্তার বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে মোবাইলে (মুঠোফোনে) ওর লগে (স্বামীর সঙ্গে) শেষ কথা হয়। ওই (নাজমুল) বলেছিল, “তুমি বাড়ি থাইক্যা কিছু টাকা পাডাও, আমি বাড়িত আইয়াম। এইনে মাহাজনও নাই, লোকজনও গেছে গা, মেসে খাইবারও পাইতাছি না। পরে আমি কইছি কালকে আমি টাকা পাডাইয়ামনে, ভোর বেলা আইয়্যা পইড়ো। আমার মেয়ের সাথেও কথা বলছে। পরে আবার ফোন দেওনের কথা আছিন। কিন্তু বিকালে ও রাতেও ফোন করে নাই।” রাত তিনটা বাজে সেহরা মুন্সিবাড়ি থেকে লোকজন আমারে ফোন দিছে যে ওই (স্বামী) মারা গেছে, ঢাকায় গুলি খাইছে। পরে সেখানে যাই। সকালে গিয়ে স্বামীর লাশ দেখতে পাই।’

শিলা আক্তার জানান, বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলত মেয়েটি। এখন সে কানে মুঠোফোন নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। তার বাবা যে আর জীবিত নেই তা বোঝার ক্ষমতা মেয়ের নেই। কান্নাকাটি করলে নানাভাবে বুঝিয়ে শান্ত করি।

মা মোছা. সাজেদার হাতে ছেলে নাজমুল ইসলামের ছবি। বুধবার দুপুরে ময়মনসিংহ নগরের সেহরা মুন্সিবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বুধবার দুপুরে কথা হয় নিহত নাজমুল ইসলামের মা মোছা. সাজেদার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় প্রতিদিন ফোন করে সাবধান করতাম। আমরা গরিব মানুষ, সংসারের একমাত্র অবলম্বন ওই (নাজমুল) আছিন। ছেলে মারা যাওয়ার পর করুণ অবস্থার মধ্যে পড়ছি। আমার ছেলেরে যে গুলি করে মারল, তারার বিচার যেন হয়।’

নাজমুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন ছোট ভাই রেজাউল ইসলাম। ২৫ আগস্ট থানায় করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৮৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।