‘এই জীবনে সাতবার ভিটা ভাঙছে গাঙ্গে। মনে করছিলাম, এই ভিটাতে মরবাম। কিন্তু তা আর অইলো না। শেষ বয়সে আইস্যা নয়া কইরা আবার ভিটা হারা হইলাম।’ নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলেন পঁচাত্তর বয়সী আবদুল খালেক। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী ইউনিয়নের খোদাবক্সপুর উত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
আজ মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনকবলিত এলাকাটিতে তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের মুখে পড়েছে আবদুল খালেকের বসতভিটা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে গত বছর ভাঙন রক্ষার উদ্যোগ নিলেও বছর না ঘুরতেই জিওব্যাগসহ ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বসতভিটা থেকে ঘরগুলো সরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। একটি বসতঘর খুলেও ফেলা হয়েছে। আর গোয়াল সরিয়ে নিয়েছেন অন্যত্র।
বসতভিটাটিতে সাত ছেলেসহ নাতি-নাতনিদের নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন বৃদ্ধ আবদুল খালেক। প্রায় পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। এর আগে চার বার তাঁর বাড়ি গ্রাস নেয় ব্রহ্মপুত্র। তিনি বলেন, সাত দফা নদের ভাঙনে তাঁর প্রায় ৫২ কাঠা জমি বিলীন হয়েছে। যে সাত কাঠা ভিটে টিকে ছিল সেটুকুও বিলীন হওয়ার পথে। নদের অন্য পাড়ে জেগে ওঠা চরে সরকারি জায়গায় নতুন করে ঘর তোলা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।
আবদুল খালেকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম অভিযোগের সুরে বলেন, ‘কদিন পরপর আমরার বাড়ি খায় গাঙ্গে। গাঙ্গে আমার সব জমি খাইছে। এহন আর যাওনের মতো যাইগাও নাই। শেষ ভিটাও খাইয়া ফাললো গাঙ্গে। আমরার মতো গরিবরে আল্লায়ও দেহে না৷’
খালেকের বাড়ির ঠিক পাশেই তাঁর ভাতিজা আশরাব আলীর বাড়ি। সেটিও ভাঙনের কবলে পড়েছে। তাঁর ছেলে হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছর আমাদের বাড়িও ভাঙে। বছর বছর একটি করে ঘর ভাঙতে হয়। আমাদের ২০ কাঠা জমি ভাঙতে ভাঙতে আড়াই কাঠায় এসে ঠেকেছে। আমরা ছাড়াও এলাকার আরও ২০টি পরিবারের একই দুর্দশা।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী ইউনিয়নের খোদাবক্সপুর, ভাটিপাড়া, উজানকাশিয়ার চর গ্রামের তিন কিলোমিটার ও ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলা ইউনিয়নের মরিচার চর গ্রামের দুই কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। সাত দিন ধরে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বাড়তে শুরু করলে নদের তীরে ভাঙন দেখা দেয়। এখন অন্তত ৩০টি বসতভিটা ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। পানি কমার সময় ভাঙনের মাত্রা আরও বাড়বে বলে তাঁদের ধারণা।
ভাঙন শুরু হওয়ায় ভিটে থেকে গাছপালা সরাতে দেখা গেছে নদপাড়ের বাসিন্দাদের। বসতভিটার পাশাপাশি ফসলি জমিও বিলীন হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদে। আজ ১০টায় গৌরীপুর উপজেলার ইউনিয়নের উজান কাশিয়ারচর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা নদীর পারে বসে আছেন। দুই বছর আগে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে এলাকাটি ভাঙন প্রতিরোধে পাউবো পদক্ষেপ নিলেও চার দিন ধরে সেখানেও ভাঙতে শুরু হয়।
উজানকাশিয়ার চর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬৯টি ঘর, একটি কমিউনিটি সেন্টার, ও কয়েক শ বাড়ি ব্রহ্মপুত্র নদে ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে বলে জানান ভাংনামারী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, চার দিন ধরে আবার নদের তীর ভাঙতে শুরু করেছে। ভাঙন না ঠেকানো গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা একেবারে ভিটেহারা হবে। একই রকম আশঙ্কা আশ্রয়ণ প্রকল্পটির বাসিন্দা রমজান আলীর।
দুই বছর আগে ভাঙন ঠেকাতে পাউবো উজান কাশিয়ার চর এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে নিয়েছিল। তবে চলতি বছর ওই সব জিও ব্যাগসহ নদীতে ভাঙতে শুরু করেছে বলে জানান উজান কাশিয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান রানা। তাঁর দাবি, এলাকাটিতে ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ তৈরি করা হোক।
ভাঙনের খবর পেয়ে ইতিমধ্যে জায়গাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। বালু তোলার ফলে সৃষ্ট গর্তের কারণে পানির স্রোত ভাঙন বাড়ছে। সবার আগে আমাদের অপরিকল্পিতভাবে নদ খনন ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ঠেকাতে হবে। বিষয়গুলো চিঠি দিয়ে সময়ে সময়ে প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।ময়মনসিংহ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উর জামিল
ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের জন্য অপরিকল্পিতভাবে নদ খনন ও অবৈধ বালু উত্তোলনকে করাকে দায়ী করেছেন ময়মনসিংহ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উর জামিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাঙনের খবর পেয়ে ইতিমধ্যে জায়গাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। বালু তোলার ফলে সৃষ্ট গর্তের কারণে পানির স্রোত ভাঙন বাড়ছে। সবার আগে আমাদের অপরিকল্পিতভাবে নদ খনন ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ঠেকাতে হবে। বিষয়গুলো চিঠি দিয়ে সময়ে সময়ে প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।’
আখলাক উর জামিল আরও বলেন, ‘গৌরীপুরের উজানকাশিয়ার চর, খোদাবক্সপুর, মরিচারচর, উজানের দিকে অষ্টাধর, ছাপরকান্দাসহ কিছু এলাকা ভাঙছে। এ ছাড়া যেসব জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে, সেসব জায়গায় জরুরি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’