বরিশাল সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভেদ নিরসনে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল কেন্দ্র। আজ শুক্রবার বিকেলে ওই কমিটির ডাকে গৌরনদীতে যৌথ সভা করে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। কিন্তু ওই সভায় যোগ দেননি আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। প্রতীক বরাদ্দের পর আজ দিনভর নগরে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি।
বর্ধিত সভা সূত্র জানায়, সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহেমদসহ কেন্দ্রীয় নেতারা যোগ দেন। তবে বর্তমান মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ ওই সভায় যোগ দেননি।
সভায় বিভেদ ভুলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খায়ের আবদুল্লাহকে জয়ী করতে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ঢাকায় থেকে নৌকাকে জয়ী করতে কাজ করবেন বলে সভায় জানানো হয়।
১৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড বরিশালে মেয়র পদে খায়ের আবদুল্লাহকে দলীয় মনোনয়ন দেয়। খায়ের আবদুল্লাহ বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর চাচা এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ভাই। মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই বরিশালে ফেরেননি সাদিক আবদুল্লাহ এবং তাঁর বাবা হাসানাত আবদুল্লাহ। একই সঙ্গে তাঁদের অনুগত জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারাও খায়ের আবদুল্লাহর পাশে দাঁড়াননি। এতে দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদ ও পরে তা সংঘাতে রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৭ মে সিটি নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য ৯ সদস্যের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেয় কেন্দ্র। ওই কমিটির প্রধান হাসানাত আবদুল্লাহ। আর প্রধান সমন্বয়ক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আজ ওই কমিটি গৌরনদী পৌরসভা মিলনায়তনে জেলা ও মহানগরের নেতাদের নিয়ে যৌথ বর্ধিত সভা ডাকে। সভায় জেলা ও মহানগরের নেতা, নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। সভায় দলীয় প্রার্থী খায়ের আবদুল্লাহর উপস্থিত থাকার কথা জানানো হলেও তিনি যোগ দেননি।
খায়ের আবদুল্লাহ সভায় যোগ না দেওয়ায় নগরজুড়ে নতুন করে আবার কানাঘুষা শুরু হয়েছে। জানতে চাইলে খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক লস্কর নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বিভেদের প্রশ্ন নেই। প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন। তিনি সেখানেই সময় দিচ্ছেন। কথা এটুকুই। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
মনোনয়ন পাওয়ার পর খায়ের আবদুল্লাহ ১৮ এপ্রিল বরিশালে আসেন। এর পর থেকে তিনি নানাভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। ফলে বরিশালের রাজনীতিতে তাঁকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী নেতা-কর্মী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক ও হাসানাত পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্যে ছিটকে পড়া পুরোনো নেতা-কর্মীরা খায়ের আবদুল্লাহকে সমর্থন দিচ্ছেন।
খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, ইতিমধ্যে ৩০টি ওয়ার্ডে নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি করে কমিটি করা হয়েছে। একইভাবে ১২৪টি কেন্দ্রের জন্য কমিটি করা হয়ে গেছে। দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত না হয়ে বরং ভাবলেশহীন আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় প্রার্থী তাঁর সমর্থক নেতাদের নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন। খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়, ৩০টি ওয়ার্ডে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীদের রাখা হয়নি।
খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি পরিবার এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে হয় স্বেচ্ছায় নয়তো ছিটকে পড়ছে। গোটা অঞ্চলের রাজনীতিতে এমন বলয় সৃষ্টি করায় দলের দুর্দিনে কোনো নেতা দাঁড়াতে পারেননি বা নেতৃত্ব পাননি। বিষয়টি বুঝতে পেরে এবার এ বলয়ের বাইরে মনোনয়ন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ সিদ্ধান্তে গণজোয়ার উঠেছে বরিশালে। সর্বস্তরের মানুষ এখন নৌকার পক্ষে। আমাদের কাছে খবর আছে, ভেতরে-ভেতরে নৌকার ক্ষতি করছেন তাঁরা। যে কারণে আমরাও তাঁদের পক্ষের লোকদের ডাকছি না বা যাচ্ছি না।’
মীর আমিন উদ্দীন আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, তাঁরা এখানে এলে প্রার্থীর লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। কারণ হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে যে শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করেছেন, তা তাঁদের প্রয়োজনে করেছেন, দলের প্রয়োজনে নয়।’
হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে দলের জাতীয় কমিটির সদস্য গোলাম আব্বাস চৌধুরী সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (খায়ের) কেন সভা বর্জন করলেন বা গেলেন না, সেটা আমরা জানি না। তবে গেলে ভালো হতো। তিনি না যাওয়ায় সবার মধ্যে একটি ভুল বার্তা যাবে। গেলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে ক্ষোভ ছিল, তা নিরসন হয়ে যেত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই বলে আসছিলাম, আমাদের নেতা হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালে আসবেন এবং নৌকাকে বিজয়ী করতে যৌথ সভা করে সবাইকে মাঠে নামাবেন। সেই কথার প্রতিফলনই আজকের সভা। তারপরও আমরা ব্যক্তি নয়, নৌকার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব, সভায় সেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সভার মধ্য দিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কাজে আন্তরিকতা ও গতি আসবে।’
সাদিক আবদুল্লাহর অনুপস্থিতির বিষয়ে গোলাম আব্বাস চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে হাসানাত আবদুল্লাহ এসেছেন, সেখানে অবশ্যই সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থন আছে। থাকাটাই তো স্বাভাবিক। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।’