জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতে কুতুবদিয়ায় চাঙা ব্যবসা-বাণিজ্য, পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুতের ঝলকানি। ঝলমল হাটবাজারের দোকানপাট। দিনের চাইতেও রাতে জমজমাট বেচাবিক্রি। স্থানীয় লোকজনের মতে, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ আসার ছয় মাসের মাথায় দ্বীপের স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষাব্যবস্থাসহ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক উন্নতি ঘটছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও ফিরে এসেছে চাঙাভাব।
গত শনি ও রোববার ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের ছয়টি ইউনিয়ন ঘুরে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র দেখা গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল গণি প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এই দ্বীপ উপজেলায় বিদ্যুৎ ছিল না। ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যাকালীন ৬০০ গ্রাহককে কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ-সংযোগ নিশ্চিত করে। গত ১৪ এপ্রিল বিদ্যুৎ সংযোগের উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক।
পিডিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে দেশের শতভাগ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ নামে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই কুতুবদিয়ায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়।
২২ অক্টোবর পর্যন্ত গত ছয় মাসে উপজেলার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপ ও আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ৫ হাজার ৫০০ গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছে জানিয়ে কুতুবদিয়া পিডিবি কার্যালয়ের আবাসিক প্রকৌশলী মো. আবুল হাসনাত বলেন, ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে উপজেলার আরও ১২ হাজার গ্রাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত হচ্ছে কুতুবদিয়া। দ্বীপের বর্তমান লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫১ হাজার।
সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫২ বছর পর কুতুবদিয়ার মানুষ জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পেয়ে লাভবান হচ্ছেন। দ্বীপে চেহারা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা, মাছ সংরক্ষণের হিমাগারসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রসার ঘটছে পর্যটনের। দ্বীপে উৎপাদিত সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, লবণ, তরমুজ, পানসহ নানা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন মানুষ।
চাঙা ব্যবসা-বাণিজ্যে
উপজেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বড়ঘোপ বাজার। এই বাজারে দোকানপাট আছে দেড় হাজারের বেশি। গত দুই দিন সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনের চাইতে রাতে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল দোকানপাটে বেচাবিক্রি চলতে দেখা গেছে।
রাত ১১টায় একতা ক্লথ স্টোরে কাপড়চোপড় বেচাবিক্রি হচ্ছিল। দোকানের মালিক নুর মোহাম্মদ (৬৫) বলেন, ৬ মাস আগেও রাত ১০টার আগে দোকান বন্ধ হয়ে যেত। এখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। তাই রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখা হচ্ছে। আগে দোকানে দৈনিক ৫-৭ হাজার টাকার কাপড় বেচাবিক্রি হতো, এখন ৩০-৪০ হাজার টাকা।
বাজারের একপাশে গভীর রাতে কাঠের তৈরি খাট, চেয়ার-সোফা বিক্রি করছিলেন ব্যবসায়ী মো. আলমগীর। জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, লোকজন সারা দিন মাঠঘাটে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। কেনাকাটা করেন রাতের বেলায়। তাই গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখা।
বড়ঘোপ বাজার দোকান মালিক সমিতির সদস্যসচিব ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবর বলেন, দ্বীপের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে বিদ্যুৎ। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা থাকছে। প্রতিটি দোকানে মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ৪০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা। চুরি-ছিনতাই নেই বললে চলে।
কুতুবদিয়া উপজেলা সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি মনজুর আলম বলেন, বিদ্যুৎ আসার পর থেকে টমটমের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে দ্বীপে টমটম চলছে দুই হাজারের বেশি। তাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে বেকারদের।
কৃষি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতি
দুই বছর ধরে দ্বীপে অবস্থান করছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমানে ৯ হাজার ৮৮০ একরে আমন চাষ হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ৯ হাজার ৭৫৫ একর।
৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবায়ও উন্নতি ঘটছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা নাদিম বলেন, আগে সন্ধ্যাকালীন কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ এবং জেনারেটর চালিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চালাতে হতো। জরুরি মুহূর্তে মোমের আলোতে অস্ত্রোপচারের কাজ সামলাতে হতো। সরাসরি বিদ্যুৎ আসাতে হাসপাতালে রাতেও অস্ত্রোপচার হচ্ছে।
গতকাল রোববার রাত আটটায় বড়ঘোপ সমুদ্রসৈকত থেকে উঠে আসার সময় কানে এল শিশুদের হইচই। কাছে গিয়ে দেখা গেল, টিনশেডের এবিসি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ছে ৫০-৬০ শিক্ষার্থী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুর রহমান বলেন, বিদ্যালয়ের গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়ানো হচ্ছে। আগে হারিকেন জ্বালিয়ে, পরবর্তী সময়ে জেনারেটরের আলোয় পড়ানো হতো। গত দুই মাস ধরে সরাসরি বিদ্যুতের আলোয় পড়ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
কুতুবদিয়া থানার কাছে এক কক্ষের কুতুবদিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ‘স্কুল ক্যানটিন’। রাত ৯টায় ক্যানটিনে বসে টেলিভিশনের পর্দায় ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন ৩০-৩৫ জন। দর্শনার্থীদের জন্য পেঁয়াজু, ডালপুরি, ডিম-পরোটা ভেজে পরিবেশন করছেন কর্মচারী বেলাল। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ দোকানের বেচাবিক্রি পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাত ১২টা পর্যন্ত দোকানে খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি টেলিভিশনে খেলাধুলা, সিনেমা দেখে সময় কাটাচ্ছেন মানুষ।
দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের দুপাশ, খোলা লবণ মাঠ, ফসলি জমির ওপর দিয়ে টানা হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, পুরো উপজেলায় এ পর্যন্ত ২৩৫ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন টানানো হয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা পাঁচ মেগাওয়াট হলেও এখন দুই মেগাওয়াটে চলছে সবকিছু।