বাবার পরে ছেলে, ৭০ বছর কেটে গেল কপোতাক্ষের ঘাটে
ছোট একটি খেয়াঘাট। পারাপারকারী নৌকাটিও বেশ ছোট। সর্বোচ্চ হয়তো ১০ জন উঠতে পারবেন সেই নৌকায়। যাত্রীদের কাদা মাড়িয়ে যেন নৌকায় না উঠতে হয়, এ জন্য বাঁশের চটা দিয়ে দুই ফুট চওড়া একটি মাচান তৈরি করা হয়েছে। মাচানের নিচটা নেমে গেছে বেশ নিচে, পানির মধ্যে। নদের দুই মাথায় আড়াআড়ি করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে দড়ি। সেই দড়ি টেনে এপার থেকে ওপারে নৌকা নিয়ে যান শেখ কামরুল ইসলাম।
ঝিনাইদহ ও যশোর হয়ে সাতক্ষীরা ও খুলনাকে দুই পাশে রেখে সুন্দরবনের কাছে গিয়ে ঠেকেছে কপোতাক্ষ নদ। বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদকে নিয়েই কবিতা লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর তাতেই দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এ নদের নাম। গত ২০ বছরের মধ্যে কপোতাক্ষ নদ হারিয়েছে তার যৌবন। মৃত নদ খনন করে জোয়ার আনার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু অবস্থা আর ফেরেনি। খননে ছোট হয়ে এসেছে এর দুই পাড়।
ছোট এই খেয়াঘাট এলাকার মানুষের কাছে ধুনা সরদারের ঘাট হিসেবে পরিচিত। ঘাটের বয়সই প্রায় শত বছর। ঘাটের এক পারে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কানাইদিয়া গ্রাম আর অন্য পারে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হরিদাশকাটী গ্রাম। সাধারণত আড়াআড়ি দূরত্বের জন্য ঘাটটি ব্যবহার করেন দুই পারের মানুষ। একসময় কামরুল ইসলামের বাবা শেখ কফিলউদ্দিন ছিলেন এই ঘাটের মাঝি। সেখান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মাঝি হয়েছেন কামরুল ইসলাম। ঘাটটিতে এখনো হাত পড়েনি সরকারের। তিনি নিজেই মাঝি, নিজেই ঘাট সংস্কার করেন। কানাইদিয়া গ্রামে ঘাটের পাড়েই বাড়ি তাঁদের।
কামরুল ইসলামের বয়স ৬৫ বছর পেরিয়ে গেছে। অসুস্থতায় কথাও স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। এরপরও দড়ি টেনে নিয়মিত মানুষ পার করছেন। ১৮ জুন দুপুরের দিকে নৌকায় বসেই গল্প জমে ওঠে কামরুল ইসলামের সঙ্গে। ঈদের পরদিন হওয়ায় সাধারণ দিনের চেয়ে মানুষের চাপ একটু বেশি।
কামরুল ইসলাম বলেন, ‘৮০ থেকে ৯০ বছর আগে ধুনা সরদার এই ঘাটে নৌকা চ্যালাইত। আমি তাঁকে দেখিনি। সে মরি গিলি আমার আব্বা এই ঘাটে নৌকা চালানো শুরু করে। আমরা প্রায় ৭০ বছর ধরি এই ঘাটে লোক পারাপার করতিছি। আমি ছোট বিলা থেকি আব্বার সঙ্গে নৌকা চালাতাম। আব্বা মরি যায়ার পর আমি নৌকা চালাতিছি। সেটাও প্রায় ৫০ বছরের মতো হয়ি গেছে।’
এই নদ আগে কেমন দেখেছেন প্রশ্ন করতেই যেন ৩০-৪০ বছর আগে ফিরে যান কামরুল ইসলাম। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে। তিনি বলেন, ‘এহান থেকি ৩০ বছর আগেও নদী ছিল প্রায় আধ মাইল চওড়া। তহন বৈঠা নিয়ে নদী পার হতিই আধ ঘণ্টা লাগি যাতু। যখন নদীতি বান আইসতো তখন আ আ করি শব্দ হুতো। প্রায় আমার সমান পানির তুফোন দেখি ভয়ে গার লোম খাড়া হয়ি যাতু। দেখতি দেখতিই নদী আমার সামনি মরি গেল। কয় বছর আগিও ভাটির সময় নদীতি কোনো পানি থ্যাকতু না, নৌকা চলতু না, তখন মানুষ হাঁটি পার হুতো।’
২০১৫ সালের দিকে কপোতাক্ষ নদ খনন শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রায় দুই বছর ধরে খননের পর আবার জোয়ার-ভাটা বইতে শুরু করে নদে। এরপর নদের আড়াআড়ি দুই প্রান্তে দড়ি বেঁধে মানুষ পারাপার শুরু করেছেন কামরুল ইসলাম।
স্মৃতি হাতড়ে কামরুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রথম যখন নৌকা পারাপার শুরু করেন, তখন যাত্রীদের কাছে থেকে নিতেন পাঁচ পয়সা করে। দশ পয়সা, চার আনা, আট আনা করে ধীরে ধীরে পয়সার পরিমাণ বাড়তে থাকে। এখন পারাপারে নেন পাঁচ টাকা। শুধু টাকার জন্য নৌকায় করে নদী পারাপার করেন না, এটাকে মানুষের সেবা দেওয়া মনে করেন তিনি।
সারা দিন ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো পার হয় তাঁর নৌকায়। রোববার ও বৃহস্পতিবার কপিলমুনির হাটের দিনসহ ঈদ, পূজার মতো বড় কোনো অনুষ্ঠান থাকলে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ে। মানুষ পারাপার করে দিনে ৫০০-৭০০ টাকা আয় হয় কামরুল ইসলামের। ভোর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত যাত্রী পারাপার করেন। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ডাক পড়লে যত রাতই হোক না কেন, ঘুম থেকে উঠে যাত্রী পার করে দেন। যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালান।
‘আব্বা ও আমি প্রায় সত্তর বছর ধরি মানুষ পার করতিছি। আমার ছেলিরা এহন আর এ কাজ করতি চায় না। তারা এহন অন্য কাজ করি আয়রোজগার করে। আমি মরি গেলি মানুষ পারাপারের এই দায়িত্ব যে কে নেবে তা আল্লাহই জানেন’—এই বলে আলাপ শেষ করেন কামরুল ইসলাম।