খুলনার ‘পরবাসী’ পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ

রাতের রান্না চলছিল ‘পরবাসী বাসা’-এর সামনে। সেখানে বাবুর্চির দায়িত্ব পালন করছিলেন পরবাসী দলটির এক সদস্য। গত বৃহস্পতিবার রাতে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি পূর্বপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

মাটির চুলার ওপর বড়সড় একটি হাঁড়ি চাপানো। এতে শিম, ওলকপি, পালংশাক, ফুলকপি, মুলা দিয়ে পাঁচমিশালি সবজি রান্না হচ্ছে। খড়ের আগুনে টগবগিয়ে ফুটছে তরকারির ঝোল। কাঠের খুন্তি দিয়ে একটু পরপর তরকারি নেড়ে দিচ্ছেন আবুল কাশেম। খুন্তির অগ্রভাগ দিয়ে সামান্য ঝোল তুলে ডান হাতের তালুতে রেখে কয়েকবার লবণ চাখলেন। অবশেষে তাঁর মুখে ধরা দিল স্বস্তির ভাব। ‘যাক, খাওয়ার মতো হইছে!’

আবুল কাশেম পেশাদার কোনো বাবুর্চি নন, একজন মৌসুমি কৃষিশ্রমিক। আমন ধান কাটা ও মাড়াইশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দিন বিশেক আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন। এখন একটি ‘পরবাসী’ দলের সদস্য। দলটির ১৫ সদস্যের জন্য তাঁকে প্রতিদিন দুই বেলা রান্না করতে হয়। তাঁদের সবার বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের খড়িয়া গ্রামে। তাঁরা সবাই কৃষিকাজ করতে গিয়েছেন দাকোপ উপজেলার সুতারখালি পূর্বপাড়া গ্রামে। সেখানে আপাতত ‘পরবাসী’ হিসেবে আছেন তাঁরা।

স্থানীয়ভাবে ‘পরবাসী’ বলতে পর বা অন্য গ্রাম/অঞ্চলের বাসিন্দা, বিশেষ করে কৃষিশ্রমিকদের বোঝানো হয় বলে জানান চালনা সুতারখালি গ্রামের বাসিন্দা ও শিক্ষক জয়তীশ রঞ্জন মণ্ডল। তিনি বলেন, যাঁরা ধান কাটার মৌসুমে মাস দু-একের জন্য আগে থেকে ঠিক করা গ্রামে এসে বসবাস করেন, তাঁদের পরবাসী বলা হয়। এসব পরবাসীর মাধ্যমে যুগের পর যুগ ধরে দাকোপ অঞ্চলে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করানো হয়। স্থানীয়ভাবে অনেকে তাঁদের ‘দাওলে’ বা ‘দাবালে’ নামেও ডাকেন।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবুল কাশেমের সঙ্গে কথা হয় সুতারখালি পূর্বপাড়া গ্রামের একটি ‘পরবাসী বাসায়’। বাসাটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৮ হাত এবং প্রস্থে ১০ হাত। বিশেষ কায়দায় পলিথিন, খড় আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ছাউনি ও দেয়ালজুড়ে দিয়ে মাটির ওপর বানানো হয়েছে অস্থায়ী ঘরটি। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরটির ওপরের ছাউনিতে খড়ের পরিমাণও বাড়ানো হয়। এলাকায় এসব অস্থায়ী ঘরগুলো ‘পরবাসী বাসা’ নামে পরিচিত। শুধু সুতারখালি গ্রামই নয়, দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন চলছে আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মৌসুম। আর এ সময়ে এলাকাগুলোতে ‘পরবাসী’ দলের সরব উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ে।

দাকোপের বিভিন্ন এলাকায় দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠে এখন আমন ধান কাটেন পরবাসী দলের সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

চুলা থেকে তরকারি নামিয়ে ভাত বসিয়ে দিতে দিতে আবুল কাশেম বলেন, তাঁদের খাওয়াদাওয়া বলতে বেশির ভাগ দিনই চলে ডাল আর সবজি। যেসব সবজির দাম কম, সেগুলো বেশি রান্না হয়।

এসব কথার মাঝে পরবাসী বাসায় দলের কয়েকজন সদস্য সেখানে হাজির হলেন। তাঁদের একজন দলটির সরদার। তাঁর নাম আকবর গাজী। এবার তিনি জানান, তাঁরা সারা বছর ঘেরের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। আমন ও বোরোর মৌসুমে খুলনা ও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করেন। তবে এলাকার মানুষ এখন ধান কাটার চেয়ে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে বেশি কাজ করছেন।

আকবর গাজীর ভাষ্য, ‘আমাদের জমিজমা নেই। গতরের ওপর সব। ধান কাইটে ১৫-১৬ মণ ধান, যা পাব তা দিইয়ে বেশ কয়েক মাসের খোরাক হবে। আর এই খোরাক জোগাড়ের জন্যি শীতকালে বাড়ি ছাইড়ে এসে এত কষ্ট করতি হয়। খোরাকের জোগাড় করতি পারাডাই সুখ।’

আট-নয় বছর ধরে এলাকাটিতে ‘পরবাসী’ হিসেবে তাঁরা আসছেন বলে জানালেন দলের সহকারী সরদার মো. মনি মিস্ত্রি। তিনি বলেন, গত আশ্বিন মাসে এলাকায় এসে জমি দেখে গেছেন তাঁরা। এরপর জমির মালিকদের সঙ্গে মৌসুমে ধান কাটার জন্য প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে উভয় পক্ষ সম্মত হলে জামানত হিসেবে বিঘাপ্রতি কিছু অর্থ (বিশ্বাসী টাকা) মালিকদের কাছে জমা দিয়ে যান শ্রমিকেরা। পরে কাজ শেষে এসব অর্থ কৃষকদের ফিরিয়ে দেন মালিকেরা। মূলত কাজের নিশ্চয়তা দিতেই এসব টাকা জমা রাখা হয়। এরপর বাড়ি শুরু করেন দল গোছানোর কাজ। স্বজন-প্রতিবেশীদের নিয়ে দল গড়ে বিশ্বাসীর টাকা ও থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ নির্ধারিত চাঁদা জমা করেন।

এসব কৃষিশ্রমিক জানান, গত নভেম্বরের একেবারে শেষ দিকে এসব শ্রমিক সুতারখালি গিয়ে ‘পরবাসী বাসা’ তৈরি করেন। সেখানে বানিয়েছেন অস্থায়ী একটি শৌচাগারও। এরই মধ্যে ১৫ জন মিলে ৮০ বিঘার মতো জমির ধান কেটে ফেলেছেন। এখন ৬০ বিঘার মতো জমির ধান কাটা বাকি আছে। এরপর চলবে মাড়াইয়ের কাজ। এরপর প্রতি ১০০ মণ ধানের বিপরীতে মালিকের কাছ থেকে তাঁরা পাবেন ১৬ মণ ধান। মাড়াই বা মলার পর ফসলের পরিমাণ অনুযায়ী ভাগাভাগি এ পদ্ধতিকে স্থানীয়ভাবে ডাকা হয় ‘মলাভাগা’ নামে।

বিশেষ কায়দায় পলিথিন, খড় আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ছাউনি ও দেয়াল জুড়ে দিয়ে মাটির ওপর বানানো হয়েছে অস্থায়ী ঘরটি
ছবি: প্রথম আলো

পরবাসীদের প্রাত্যহিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে সাইফুল নামের এক সদস্য জানান, ফজরের আজানের পরপর সবাই জেগে ওঠেন। এর অনেক আগে থেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত বাবুর্চি রান্নার কাজ শুরু করেন। এরপর খেয়েদেয়ে ছয়টার মধ্যে তাঁরা ধান কাটতে চলে যান। সবকিছু গুছিয়ে সকাল আটটার দিকে বাবুর্চি অন্য সদস্যদের সঙ্গে কাজে যোগ দেন। সকালেই দুপুরের জন্য রান্না করে ফেলা হয়। পরে বেলা একটার মধ্যে সবাই বাসা ফিরে গোসল সারেন। এরপর দুপুরে খাবার খেয়ে মাঠে যান। রাতের খাবার রান্নার জন্য বাবুর্চিকে আসরের আজানের পর পরবাসী বাসায় পাঠানো হয়। অন্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়। এরপর দরকারি কাজ সেরে বাসার মধ্যেই আড্ডা-গল্পে মেতে ওঠেন কেউ কেউ। কেউ কেউ একটু-আধটু তাস খেলেন। কেউ স্থানীয় বাজারে একটু চা খেতে যান। তবে যা–ই হোক না কেন, এশার নামাজের সময় সবাই আবার বাসায় একত্র হন।

এবার রাতের খাবার খেয়ে সবার ঘুমানোর পালা। বিশেষ কায়দার ঘরটির ভেতরে মাটির ওপর খড় বিছিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিছানা। এর ওপর আবার বিছানো হয়েছে খালি সিমেন্টের বস্তা। প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী শীতের কাঁথা-কম্বল ব্যবহার করে সেখানে শুয়ে পড়েন তাঁরা। শ্রমিকেরা জানান, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পুরোটা সময় তাঁদের এভাবেই কাটাতে হয়। এ সময়টাতে একবারও নিজেদের বাড়িতে যান না।

পরবাসী বাসার অদূরে স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন মিলে গল্প করছিলেন। তাঁদের মধ্যে আশিস মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি জানান, আগে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে ‘পরবাসী’ গ্রামটিতে আসতেন। পরবাসীদের সঙ্গে তাঁদের একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠত। একই দল একই জায়গায় বছরের পর বছর ফিরে আসত। এখন দিনমজুর দিয়ে ধান কাটা–মাড়াইয়ের কাজ বেশি করা হচ্ছে। দিন দিন পরবাসী দলের সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে।