ঘুরে দাঁড়াতে চান ফেনীর সব হারানো কৃষকেরা
৩০ শতাংশ জমিতে আমনের চাষ করেছিলেন ফেনীর ফুলগাজী ইউনিয়নের ৩৫ বছর বয়সী কৃষক দেলোয়ার হোসেন। ধানগাছের বাড়বাড়ন্ত দেখে মনে দোলা লেগেছিল। মৌসুমি বাতাসে সবুজের ঢেউ মনে দোলা দিয়েছিল। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেল।
দেলোয়ারের টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরখানি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে জলকাদা মিশ্রিত পুরোনো ভিটেমাটিতে। গতকাল শুক্রবার সকালে বাড়ির ধ্বংসস্তূপের পাশেই দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। ক্লান্ত, অবসন্ন, বিষণ্ন দেলোয়ার কথা বলার শক্তি পাচ্ছিলেন না। আশপাশের গাছপালা ও পাকা স্থাপনাগুলোতে ৭ থেকে ৮ ফুট পানির দাগ। বাতাসে উৎকট গন্ধ। চোখ মুছতে মুছতে দেলোয়ার বলেন, ‘বেয়াগুন শেস গরি দি গেছেগুই হানি (সবকিছু পানিতে শেষ হয়ে গেছে)।’
‘আউশ ধান কাটার সময় আর আমন চাষের সময় এই বন্যার ক্ষতি অপরিসীম। জুলাই মাসের শেষ আর আগস্টের প্রথম দিকে আউশ ধান কাটা শুরু হয় এবং আমনের চাষ শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টির কারণে আউশের সব ফসল ঘরে আনা যায়নি। আর বন্যার কারণে ভেস্তে গেল আমন ধানের স্বপ্ন।’
দেলোয়ারের মতো এ রকম হাজারো কৃষকের নবান্নের স্বপ্নকে ভাসিয়ে দিয়ে জীবনটাকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। মধ্য ভাদ্রের এ সময়টাতে কৃষক আশায় বুক বাঁধে আশ্বিনে ঘরে আসবে নতুন ধান। ঠিক এ সময় পানির এমন দৈত্যের মতো আচরণ কৃষকদের জীবনটা যেন লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। পূর্ব ফাজিলপুর গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ শাহজাহান বললেন, ‘আঙ্গো জমিনত বুইজজেননি, এক হসলি (ফসলি) চাষ হয় (আমাদের জমিতে এক ফসলের চাষ হয়)।’
শুধু ফাজিলপুর ও ফুলগাজী নয়; ফেনীর ফুলগাজী, মুন্সীরহাট, দরবারপুর, আনন্দপুর, আমজাদহাট, জিএমহাট, পাঁচগাছিয়া, ধলিয়া ছাগলনাইয়ার বাথানিয়া ঘুরে ফসল ধ্বংসের কারণে মানুষের আহাজারি শোনা গেল। বাথানিয়ার ভূমিহীন কৃষক আমির হোসেন তিন কানি জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছিলেন। তাঁর সংসারে তিন কন্যা আর স্ত্রী। পানির স্রোতে ঘর ভেসে গেছে, ধানখেত হয়েছে বিরান। বিভিন্ন এলাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা মানুষের দিকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই। শহর পেরিয়ে গ্রামে গেলেই এ রকম আফসোসের সুর, কান্নার কথা সবার মুখে মুখে।
আবদুর রউফ নামের আরেকজন ভূমিহীন বর্গাচাষি বললেন, ‘অন যদি সরকারের সায্য হাইতাম, ফ্রি বীজ হাইতাম, তাইলে চেষ্টা গরি চাইতাম এই মৌসুমত চাষ গরিত ফাইত্তাম। (এখন যদি বিনা পয়সায় বীজ দিয়ে আমাদের সাহায্য করে, তাহলে এই মৌসুমেই আরেকবার চাষের চেষ্টা করতাম)।’ প্রকৃতির কাছে হেরে না গিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন রউফের মতো অনেকের মনে। তাঁদের মনোবল আছে। কিন্তু বীজ এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় খাবারদাবার, নিরাপদ আশ্রয়হীনতা তাঁদের কাবু করেছে আপাতত।
ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক একরাম উদ্দিন গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আউশ ধান কাটার সময়, আর আমন চাষের সময় এই বন্যার ক্ষতি অপরিসীম। জুলাই মাসের শেষ আর আগস্টের প্রথম দিকে আউশ ধান কাটা শুরু হয় এবং আমনের চাষ শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টির কারণে আউশের সব ফসল ঘরে আনা যায়নি। আর বন্যার কারণে ভেস্তে গেল আমন ধানের স্বপ্ন।’
একরাম উদ্দিন আরও বলেন, এবার ফেনীতে ৩২ হাজার ৪৮৬ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। এর ৯৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩১ হাজার ১৪৬ হেক্টর ধানখেত তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে আউশের চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। সময়মতো কাটাও শুরু হয়েছিল জুলাই মাসের শেষ দিকে। প্রায় কাটাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিরামহীন বৃষ্টি বাদ সাধে সব ধান ঘরে তুলতে। বৃষ্টি যখন শুরু হয়, তখন ২ হাজার ৬৪১ হেক্টর জমির ধান তোলা বাকি ছিল। এসবের মধ্য ১ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
শুধু ধান নয়, শরৎকালীন নানা সবজিখেতও নষ্ট হয়েছে এই বন্যায়। ফুলগাজীতে দেখা হলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজিজুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গবাদিপশু, হাঁস–মুরগির সব খামার বিলীন হয়ে গেছে। ফেনীতে ঘুরে আপনি কোথাও গরু-ছাগল খুঁজে পাবেন না।’
আজিজুল হকের কথামতো ফেনীর সব এলাকা ঘোরা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যেসব এলাকায় সরেজমিন ঘোরা সম্ভব হয়েছে, সেখানে হাঁস ছাড়া অন্য কোনো গবাদিপশু কিংবা পাখি চোখে পড়েনি। একটা পুরো জনপদকে কাদাজলের চরে পরিণত করেছে এই বন্যা। ফেনীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ৫২৫ হেক্টর জমিতে শরৎকালীন নানা ফসলের চাষ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আদা, আখ, হলুদ। এগুলোর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে ২ নম্বর পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে এসে দেখা গেল, ত্রাণ ও সাহায্যপ্রার্থী মানুষের ভিড়। সেখানে দেখা পাওয়া গেল সমাজকর্মী ও কলেজশিক্ষক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম শাহিনের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বন্যা–পরবর্তী লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছে। পানি কমতে শুরু করেছে। গাছ পচেছে, ফার্মের মুরগি, গরু ছাগল মরে পচে গলে গেছে। বাতাসে দুর্গন্ধ, পানীয় জলের সংকট, কোথাও কোথাও পানি নামছে না। আবার নতুন করে কোনো কোনো এলাকায় পানি বাড়ছেও। এখন মানুষের জন্য প্রয়োজন পান করার যোগ্য পানি এবং ওষুধ। প্রচুর ত্রাণ আসছে। সে তুলনায় ওষুধ ও পানি কম আসছে। হতাশ কৃষকদের মধ্যে আশা ফিরিয়ে আনা জরুরি। তাঁরা নিজের জমিতে ফিরে যেতে পারলে মনের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।’
পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে মুখ মলিন করে বসে ছিলেন সব হারানো কৃষক আমির হোসেন (৪০)। তিনি বললেন, ‘আঙ্গোরে কিছু দিয়েন না। নয়া গরি চাষ করবাল্লাই ধানের বীজ দেন চাউরগা। গা গতর হাডি আবার নয়া গরি হাম শুরু গইরতাম (আমাদের আর কিছু দিতে হবে না। নতুন করে চাষ করতে বীজ দেন। গায়ে খেটে কাজ শুরু করব)।’
তাঁর কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রণব চন্দ্র মজুমদারের মুখে। তিনি বললেন, ‘গ্রামের কৃষক, চাষিরা এখন চাষের জন্য বীজের সন্ধান করছেন। এখন বীজ সংগ্রহের জন্য সাহায্য করাই সবচেয়ে উত্তম সাহায্য হবে। কৃষক আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চান। এখন আমরা বীজ সংগ্রহের কাজে নামব জোরেশোরে। কারণ, নতুন করে আমন আবাদের সময় এখনো আছে।’
প্রণব চন্দ্র মজুমদারের কথা শুনে কিংবদন্তি গায়িকা শেফালী ঘোষের একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর গানের কথাগুলো ছিল এমন, ‘গর্কি তুয়ান-বইন্যা-খরা মোহামারি ঘুন্নিঝড়/ ভাসায় মারে, ধ্বংস গরে, মাইনসে তো আর বই ন লর/ অক্কল হামর ধান্দা চলে আবার নয়া সিষ্টি অর। (গোর্কি, তুফান, বন্যা, খরা, মহামারি, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ভাসিয়ে মারে, ধ্বংস করে, মানুষ তবু বসে থাকছে না। সব কাজের চাকা ঘুরছেই, আবার নতুন নতুন সৃষ্টি চলছে।’