হাজারো মুসল্লির ‘আমিন, আমিন’ ধ্বনিতে মুখর তুরাগতীর
টঙ্গীর তুরাগতীরে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আজ রোববার সকালে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন দূরদূরান্তের হাজারো মুসল্লি। এ সময় তাঁরা দুহাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মঙ্গল কামনা করেন দেশ, জাতি ও মানবতার।
এক দিন আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত হবে সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে যেকোনো সময়। গতকাল শনিবার রাতের মধ্যেই ভরে যায় পুরো ইজতেমা মাঠ। কেউ কেউ অবস্থান করেন সড়ক ও আশপাশের গলিতে। আজ ভোর থেকে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার মুসল্লিরা দলে দলে জড়ো হতে থাকেন গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের দিকে।
আজ সকাল থেকে সরেজমিন দেখা যায়, আকাশ পরিষ্কার। শীত কম, কুয়াশাও নেই। এমন পরিবেশে তুরাগতীরে এগিয়ে চলছে মানুষের ঢল। যত দূর চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। সড়ক, মহাসড়ক, খোলা জায়গা, ঘরবাড়ির ছাদ, তুরাগপাড়ে ভিড়িয়ে রাখা নৌকা, থমকে থাকা বাস, ট্রাক বা পিকআপ ভ্যান—সব জায়গায় মানুষ। কেউ বসে আছেন, কেউ দাঁড়িয়ে কান পেতে আছেন মাইকের শব্দে। সবার অপেক্ষা আখেরি মোনাজাতের জন্য।
সকাল ৯টা ১ মিনিটে শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত মোনাজাত। ঢাকার কাকরাইল মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা জুবায়েরের কণ্ঠ ভেসে এল মাইকে, ‘হে আল্লাহ, আমাদের জানা–অজানা সব গুনাহ মাফ করে দেন। আমাদের ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত—সব গুনাহ মাফ করেন। আপনি মাফ না করলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, আপনি আমাদের রক্ষা করুন।’
মুসল্লিদের কারও চোখ তখন বন্ধ, কারও দৃষ্টি সুদূরে প্রসারিত, কেউ অশ্রুসিক্ত। দুই ঠোঁটের ফাঁক গলে শুধু বেরিয়ে আসছিল ‘আমিন, আমিন’ ধ্বনি। হাজারো মুসল্লির সমবেত সেই ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
২২ মিনিটের মোনাজাতে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা। মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে দোয়া প্রার্থনা করা হয়। এ ছাড়া মানুষের মধ্যে হেদায়েত, রোগ থেকে আরোগ্য লাভ, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করা হয়।
এর আগে বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তৃতীয় দিন বা শেষ দিনের কার্যক্রম। বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। এরপর কিছু সময় নসিহতমূলক কথা বলেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। এরপর কিছু সময় কথা বলেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা জুবায়ের।
১৯৬৩ সাল থেকে বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের আয়োজনে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০১৮ সালে তাবলিগের বর্তমান আমির ভারতের দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে আমির মানা না-মানাকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়ে তাবলিগ জামাত। ওই বছর ইজতেমায় অংশ নিতে বাংলাদেশে এসে বিরোধের মুখে ফিরে যান তিনি। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের বিরোধে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তুরাগ ময়দানে সংঘর্ষে নিহত হন এক মুসল্লি। এরপর ২০১৯ সাল থেকে দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমা শুরু করে।
এবারও বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আলাদাভাবে। গত শুক্রবার আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম পর্বের ইজতেমা। এ পর্বের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা হবে ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি। এ পর্বের নেতৃত্ব দেবেন ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা।
এদিকে মোনাজাতে অংশ নিতে সকাল থেকেই টঙ্গীর তুরাগপাড়ে জমায়েত হতে থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। তাঁদের পদচারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরা হাউসবিল্ডিং থেকে গাজীপুরা, টঙ্গী-ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়কের টঙ্গী স্টেশনরোড থেকে আমতলী, আবদুল্লাহপুর–আশুলিয়া সড়কের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ছিল প্রচুর মানুষের সমাগম। এ ছাড়া তুরাগ নদের পাড়ে, ভেড়ানো নৌকা, আশপাশের দোকানপাট, কারখানায় ছিলেন প্রচুর মানুষ। এ সময় তাঁরা খবরের কাগজ, জায়নামাজ ও পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েছিলেন যিনি যেখানে পেরেছেন সেখানে।
মোনাজাতে অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের চলাচলের সুবিধার্থে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে ভোগড়া বাইপাস, টঙ্গী ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়কের মিরের বাজার থেকে স্টেশন রোড, কামারপাড়া-মন্নুগেট সড়ক ও আবদুল্লাহপুর থেকে কামারপাড়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
ইজতেমার আয়োজক কমিটি জানিয়েছে, এবার ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইরান, কম্বোডিয়াসহ ৫১টি দেশের ২ হাজার ৫৪০ জন বিদেশি মেহমান অংশ নেন।