দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের সব কটি পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। এই প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কৃষকদের সেচের পানি দেওয়া হতো। সর্বশেষ চার উপজেলায় একটি পাম্পের সাহায্যে পানি সরবরাহ চালু ছিল। দুই সপ্তাহ ধরে সেটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বোরো ধানের চারা রোপণের এই সময় এক লাখের বেশি কৃষক বিপদে পড়েছেন।
জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় তিনটি পাম্পের সাহায্যে পানি দেওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে দুটি পাম্প বন্ধ ছিল। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা—এই চার উপজেলার কৃষকেরা দুর্ভোগে পড়েছেন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না, কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন। এতে ধান উৎপাদনে খরচ ১২ থেকে ১৫ গুণ বেড়ে গেছে।
তিনটি পাম্পই বিকল হয়ে আছে। কৃষক প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘আপনারা (কৃষক) আপনাদের মতো চালিয়ে (সেচ) নেন।’নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া কার্যালয়ের উপপরিচালক হায়াত মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পাম্প বন্ধ হওয়ার কারণে বোরো চাষে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে। হয়তো ফলন কম হবে। যা মনে হচ্ছে, কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
কবে নাগাদ পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হবে, তা বলতে পারছেন না পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। ভেড়ামারায় অবস্থিত পাউবোর গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রধান পাম্পহাউসের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি পাম্পই বিকল হয়ে আছে। কৃষক প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘আপনারা (কৃষক) আপনাদের মতো চালিয়ে (সেচ) নেন।’
পদ্মায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় তিন-চার বছর আগে থেকে বোরো মৌসুমে শুধু কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়। মাগুরা ও ঝিনাইদহের খালগুলোর কপাট বন্ধ রাখা হয়।
সারা বছর পানি থাকত
১৯৫১ সালে প্রাথমিক জরিপের পর ১৯৫৪ সালে জি-কে সেচ প্রকল্প অনুমোদন পায়। চালু হয় ১৯৬২-৬৩ সালে। পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তিনটি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ১৩টি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় সেচযোগ্য এলাকা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর।
পাউবো ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত আমন চাষে পানির ঘাটতি মেটাতে প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটি প্রায় সারা বছরই তিন মৌসুমে কাজে দিচ্ছিল। তবে পদ্মায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় তিন-চার বছর আগে থেকে বোরো মৌসুমে শুধু কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়। মাগুরা ও ঝিনাইদহের খালগুলোর কপাট বন্ধ রাখা হয়। সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে বলে জানালেন কৃষকেরা।
১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ নম্বর পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌনে পাঁচটায় পাম্পটি বিকল হয়ে যায়। ফলে সেচের পানি সরবরাহ এখন পুরোপুরি বন্ধ।
একে একে বন্ধ পাম্প
পদ্মায় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকলে প্রকল্পের একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ২৮ হাজার ৩১৬ দশমিক ৮৫ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। তিনটি পাম্পের মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর পাম্প দুটি কয়েক বছর ধরে বিকল। এ ছাড়া বিকল্প হিসেবে আরও ১২টি ছোট পাম্প ছিল। সেগুলোও ২০০১ সাল থেকে বিকল।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি সেচ প্রকল্পের আওতায় খালে পানি সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু তখন পদ্মায় পানির স্তর নেমে গিয়েছিল। এ ছাড়া ভেড়ামারায় প্রধান খালের ওপর একটি সেতু নির্মাণ চলছিল। সেখানে মাটি ফেলে খালের অনেকাংশ ভরাট করে রাখা হয়। এসব কারণে সময়মতো পানি সরবরাহ সম্ভব হয়নি। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ নম্বর পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌনে পাঁচটায় পাম্পটি বিকল হয়ে যায়। ফলে সেচের পানি সরবরাহ এখন পুরোপুরি বন্ধ।
এখন খেতে ধানগাছ পানির অভাবে শুকি মইরে যাচ্চে।আলমডাঙ্গার ডাউকী গ্রামের কৃষক বদরুল আলম
দিশাহারা কৃষক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জিকে সেচ প্রকল্পের পানিতে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলার অন্তত ১ লাখ ৬ হাজার কৃষক বোরো আবাদ করতে পারতেন।
কৃষকেরা বলছেন, বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি সেচ দিতে হয়। খেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে দানা আসা পর্যন্ত সেচ লাগে। কখনো দিনে দুই বেলাও সেচ দিতে হয়। জানুয়ারি থেকেই ধান আবাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পানি সরবরাহ শুরুর ১৯ দিনের মাথায় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের এখন দিশাহারা অবস্থা।
কুষ্টিয়া সদরের বটতৈল এলাকার কৃষক শেখ রাজু ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধান চাষ করেন। এবারও দেড় বিঘা জমিতে ধান লাগানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু পানির অভাবে এখনো লাগাতে পারেননি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কথা হয় একই এলাকার কৃষক আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১৫ দিন আগে ২ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। কিন্তু পানি পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ দিতে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আলমডাঙ্গায় জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি আছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমি এখনো অনাবাদি পড়ে আছে।
আলমডাঙ্গার ডাউকী গ্রামের কৃষক বদরুল আলম খালে পানি আসার পর ছয় বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এখন খেতে ধানগাছ পানির অভাবে শুকি মইরে যাচ্চে।’
এই সময়ে পদ্মায় পানি কম থাকায় দুটি জেলার মাত্র চারটি উপজেলায় পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কৃষকদের একটু সমস্যা হবে। কবে নাগাদ পাম্প চালু হবে, সেটাও কর্তৃপক্ষ বলতে পারছে না।সেচ প্রকল্পের উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল বাতেন
খরচ শুধু বাড়ছে
আলমডাঙ্গা উপজেলার হাউসপুর গ্রামের কৃষক রজব আলী বংশপরম্পরায় খালের পানি দিয়ে ধান চাষ করেন। খালে পানি এলে গত ১০ ফেব্রুয়ারি এক বিঘা জমিতে ধান লাগান তিনি। কিন্তু ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পানি পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে শ্যালো ইঞ্জিন ভাড়া করে সেচ দিচ্ছেন। এই বর্গাচাষি বলেন, ‘খালের পানির জন্যি গুনতি হয় ২০০ ট্যাকা। এবেড্ডা (এবার) ছ্যালো মেশিন ভাড়া বাবদ দিতি হবে এক মণ ধান। সাথে ৫ হাজার ট্যাকার ডিজেল কিনতি হবে। জমির মালিকির দিতি হবে ৮ মণ ধান। সপ নিয়ে চিন্তায় আচি।’
কৃষকদের সংগঠন আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষক জোটের মাঠ সমন্বয়কারী সিরাজুল ইসলাম বলেন, খালে পানি না আসায় সেচের পেছনে ডিজেল ও মেশিন ভাড়াসহ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হবে কৃষকের। বাড়তি খরচের আশঙ্কায় অনেক কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবিলম্বে পানি সরবরাহ চালু করে হাজারো কৃষককে বাঁচাতে হবে। না হলে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
পানি পাওয়া অনিশ্চিত
এই পাম্প দেশীয় প্রকৌশলী দিয়ে মেরামত করা সম্ভব না জানিয়ে পাউবোর ভেড়ামারা পাম্পহাউসের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাম্পগুলো স্থাপন করেছিল জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক বছরের পুরোনো হওয়ায় একটু জটিলতা দেখা দিয়েছে। অবশ্য মাঝে একবার দেশি প্রকৌশলী দিয়ে পাম্প মেরামত করা হয়েছিল।
সেচ প্রকল্পের উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে পদ্মায় পানি কম থাকায় দুটি জেলার মাত্র চারটি উপজেলায় পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কৃষকদের একটু সমস্যা হবে। কবে নাগাদ পাম্প চালু হবে, সেটাও কর্তৃপক্ষ বলতে পারছে না।