‘ছেলের খুনিরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পায়, আর আমি বিচার পেলাম না’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২০১৬ সালের ১ আগস্ট ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মার্কেটিং বিভাগের সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ। দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনার আট বছর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দোষী ব্যক্তিদের কাউকেই শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমনকি শেষ হয়নি মামলার তদন্ত কার্যক্রমও। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত খালিদের স্বজনেরা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন বাবা মো. জয়নুল আবেদীন ও মা ফাতেমা আক্তার। এ সময় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফাতেমা আক্তার।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় ২০০৭ সালের ২৮ মে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন খালিদ সাইফুল্লাহ। পরিবারের একমাত্র ছেলে খালিদের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা সদরে। ২০১৬ সালের পয়লা আগস্টের প্রথম প্রহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের পর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান খালিদ।
সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের কুলাঙ্গাররা। সেদিন ছাত্রলীগের হাতে রক্ত রঞ্জিত হয়ে আমার ছেলে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। আমার ছেলের খুনিরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পায়, আর আমি এখনো ছেলে হত্যার বিচার পেলাম না। আমি চাই, ছেলের হত্যায় জড়িত সব আসামির বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিল করা হোক এবং তাদের মধ্যে যারা চাকরি পেয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের চাকরি বাতিল করা হোক।’
ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। অথচ আমার ছেলেকে হত্যার পর সংবাদমাধ্যমে তাকে কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাহলে আজ পর্যন্ত কেন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার করল না? আমার ছেলের নামে কেন একটা হলের নাম হলো না? কেন আমার ছেলের নামে একটা রাস্তা হলো না? আমার ছেলে যদি সত্যিই ছাত্রলীগ করে থাকত, তাহলে কেন ক্যাম্পাসে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন (ফলক) নেই?’
ছেলে হত্যায় জড়িত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার নাম বলেন ফাতেমা আক্তার। তিনি বলেন, তাঁদের কয়েকজন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে কর্মরত। খালিদ সাইফুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চাকরিদাতা সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরীর শাস্তি দাবি করেন এই মা।
নিহত খালিদ সাইফুল্লাহর বাবা মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার রাজনৈতিক কারণে হয়নি এত দিন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ছেলে হত্যার বিচার চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই।’
নিহত খালিদের স্বজন ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, খালিদ হত্যার ঘটনায় ২০১৬ সালের ১ আগস্ট ১০০ থেকে ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সাদেক হোসেন মজুমদার। এ মামলায় এখন পর্যন্ত চারটি অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে ডিবি, সিআইডি ও পিবিআই। কিন্তু প্রতিবারই নিহত খালিদের মা ফাতেমা আক্তার মামলার অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন কুমিল্লা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মারুফা নাজনীন। সর্বশেষ গত বছরের শেষের দিকে পিবিআই ১০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। এর আগের তিনটি অভিযোগপত্রে ৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মারুফা নাজনীন বলেন, ‘আমি প্রায় দুই মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। এখন পর্যন্ত মামলাটির চারটি অভিযোগপত্র হয়েছে। তাই বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করছি। তদন্তকাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে।’