ভাগাড়ে পরিণত জামালপুর শহরের বংশ খাল
বংশ খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। খালের কালো পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালের পাড়ের বাসিন্দাদের চলতে হয় নাক চেপে।
জামালপুর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বংশ খাল। এ খাল ঘিরে গড়ে উঠেছিল জামালপুর শহর। বর্তমানে খালটি যেন শহরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বংশ খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। খালের কালো পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালের পাড়ের বাসিন্দাদের চলতে হয় নাক চেপে।
শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন ও পয়োনিষ্কাশনের জন্য একসময় বংশ খালটি ভূমিকা রেখেছে। আর এখন খালে ময়লা-আবর্জনার স্তূপের কারণে মশার প্রজননকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। পৌরবাসী বংশ খালের ময়লার স্তূপ অপসারণ করে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে এলেও কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে শহরের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে শহরে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।
বংশ খাল পাড়ের বাসিন্দা মো. দেলুয়ার হোসেন। তাঁর বাসার জানালা-দরজা খোলামাত্রই খালের পচা-বিষাক্ত দুর্গন্ধ ঢুকে পড়ে। দেলুয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত সাত-আট বছরে খালটির ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হয়নি। পুরো খালটি আবর্জনায় ভরে পয়োনিষ্কাশন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। খালপাড়ের বাসিন্দারা বড় দুর্ভোগের মধ্যে আছেন। খালের পচা পানির দুর্গন্ধে ঘরের মধ্যে থাকা যায় না। খালটির পানিপ্রবাহ ঠিক থাকলে, এই সমস্যা হতো না। খালটি মশা ও পোকামাকড় উৎপাদনের কারখানায় রূপ নিয়েছে।
গত রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, খালজুড়ে বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বর্জ্য ভাসছে। কোথাও কোথাও খালের মধ্যে লতাপাতা গাছে ভরে গেছে। খালটির কাছে যেতেই পচা-দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগল। খালের ময়লা-আবর্জনার ওপর মশা ও মাছি উড়ছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালটি একসময় ছিল বংশাই নদ। কালের পরিক্রমায় সেই নদ হয়েছে বংশ খাল। প্রায় ২০০ বছর আগে খালটি তৈরি হয়েছে। জামালপুর থেকে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের শাখানদ হিসেবে বংশাই নদ টাঙ্গাইল ও গাজীপুর হয়ে তুরাগ নদে মিশে ছিল। এই নদের দৈর্ঘ্য ২৩৮ কিলোমিটার ছিল। জামালপুর শহরের অংশটুকু মরে গলেও টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকা জেলায় বংশাই নদের অস্তিত্ব এখনো আছে।
পুরোনো বংশাই নদ হলেও জামালপুর শহরের অংশটুকু সবাই এখন বংশ খাল হিসেবেই পরিচিত। একসময় খালটি পুরোপুরি দখল হয়ে যায়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বংশ খাল অনেকটা দখলমুক্ত করা হয়। সে সময় খালের তলদেশে আরসিসি ঢালাইয়ের মাধ্যমে পানিপ্রবাহের জন্য ড্রেনের মতো তৈরি করা হয়। জামালপুর পৌর শহরের পানি নামার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বংশ খালটি। তবে খালটি এখন ময়লার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে।
জামালপুর জেলা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, বংশ খাল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসের পটভূমি চলেই আসে। মোগল আমলে বর্তমান জামালপুর শহরের রানীগঞ্জ বাজারসংলগ্ন চাপাতলা ঘাট থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় খালটির। স্বচ্ছ পানিতে নানা সুস্বাদু মাছের অভয়াশ্রম ছিল। পালতোলা নৌকার বহর যেত এই খাল দিয়ে। বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রহ্মপুত্র হয়ে এই খালে পাট, পাটজাত পণ্যসহ নানা পণ্যসামগ্রীর বড় বড় নৌকা এসে এখানে থামত। ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে বংশ খালের পাড়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কালের বিবর্তনে ও ভোগবাদী মানুষের লালসার শিকার হয়ে বংশ খালের জামালপুরের অংশটুকু মরে গেছে।
জাহাঙ্গীর সেলিম আরও বলেন, ভরাট আর দখল হতে হতে এখন তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং তিন মিটার প্রস্থ অবয়ব নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে বংশ খালটি। গেটপাড়, মালগুদাম হয়ে শহরের মাঝখান মৃধাপাড়া, মুকুন্দবাড়ি, দয়াময়ী মোড়, মেডিকেল রোড, রানীগঞ্জ বাজার হয়ে চাপাতলা ঘাট দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে এসে মিশেছে খালটি। শহরের পানি প্রবাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালটি পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব পৌরসভা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু গত ১০ বছরেও খালটি পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ময়লা, আবর্জনার স্তূপে মশা ও মাছি থেকে শুরু করে ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের বসতি হয়েছে বংশ খাল।
বংশ খালটির বিষয়ে জানতে চাইলে মৃধাপাড়া এলাকায় মধ্যবয়সী এক নারী ক্ষুব্ধ হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, শহরের মধ্যে খালটির চারপাশে মানুষের বসবাস। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে খালটির কারণে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। খালের কাছ দিয়ে হেঁটে গেলেও সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এত পচা-দুর্গন্ধ। খালটির গভীরতা সাত থেকে আট ফুট। কিন্তু ময়লা পরিষ্কার না করায় এখন ভরাট হয়ে গেছে। কার কাছে এসবের প্রতিবাদ করবেন, প্রতিবাদ করতে গেলে আরও বিপদ। তাই সবাই এর মধ্যেই থাকেন।
জামালপুর পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, এ বিষয়ে সবার আগে নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। বাসাবাড়ির সব বর্জ্য খালে ফেলা হয়। অনেকবার চেষ্টা করেছেন, যাতে খালে কোনো প্রকার বর্জ্য না ফেলা হয়। কিন্তু কেউ কথা শোনেন না।