সীতাকুণ্ডে ৫৫ হতদরিদ্র ‘গায়েবি’ ঋণের ফাঁদে
দিনমজুর ইমাম হোসেন। তাঁর ঝুপড়ি ঘরের টিনের চালা ভেঙে পড়ার অবস্থা। চালের ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতর ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টির পানি। টাকার অভাবে তিনি ঘরের চাল মেরামত করতে পারছেন না। এরই মধ্যে ১০ আগস্ট জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখা তাঁকে পৌনে ৮ লাখ টাকার ঋণখেলাপি ঘোষণা করে ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেয়। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
এমন নোটিশ পেয়ে হতভম্ব ইমাম হোসেন। তিনি ঋণ নেওয়া তো দূরের কথা, কখনো ঋণের জন্য আবেদনও করেননি বলে দাবি তাঁর। ইমামের প্রতিবেশী সালেহা বেগম মারা গেছেন ২০২১ সালের ১৯ জুন। সালেহার স্বামী ফয়েজ উল্ল্যাহও একই দিন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের নোটিশ পান। কিন্তু কিসের ঋণ, আর কে নিয়েছেন ঋণ, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। ফয়েজ উল্ল্যাহ ও তাঁর মৃত স্ত্রী কখনো ঋণের জন্য আবেদনই করেননি বলে জানান। অথচ ব্যাংকের নোটিশে কৃষক ফয়েজ জানতে পারেন, মৃত স্ত্রী ও তাঁর নিজের নামে ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ তোলা হয়েছে।
শুধু ইমাম হোসেন ও ফয়েজ উল্ল্যাহ নন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারিটোলা গ্রামের ৫৫ জন হতদরিদ্র মানুষ, প্রায় কোটি টাকার এমন গায়েবি ঋণের ফাঁদে পড়েছেন বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করছেন। যাঁরা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন, তাঁদের কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউ বাবুর্চির কাজ করেন, আবার কেউ দিনমজুর। তাঁরা কেউ জানেন না তাঁদের নামে জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখায় একাধিক হিসাবের বিপরীতে প্রায় কোটি টাকার ঋণ তোলা হয়েছে। তাঁদের প্রতিজনের একেকটি হিসাবের বিপরীতে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। ঋণের ধরন কৃষিকাজ ও ক্ষুদ্রশিল্প উল্লেখ করা। ঋণ পরিশোধের এমন নোটিশে তাঁদের দিশাহারা অবস্থা।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৫৫ জন লোক এ রকম প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন বলে জানতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে ফয়েজ উল্ল্যাহ, নাসরিন আকতার, ইমাম হোসেন, বিবি মরিয়ম ও আবদুল আলিম বাদী হয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আহমেদুর রহমানকে আসামি করে সীতাকুণ্ড থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। ঋণ দেওয়াতে কোনো প্রতারণা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
শাখাটির ব্যবস্থাপক মিটন ঘোষ স্বাক্ষরিত ঋণ পরিশোধের নোটিশগুলোতে বলা হয়, ঋণগ্রহীতারা ১৫ দিনের মধ্যে সুদসহ সমুদয় অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই নোটিশ পেয়ে ভুক্তভোগীরা যান জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখায়। সেখানকার কর্মকর্তারা তাঁদের বলেন, ২০২১ সালে তাঁরা ঋণ নিয়েছেন। তাঁরা এখন ঋণখেলাপি। সালেহা ও তাঁর স্বামী কৃষক ফয়েজ উল্ল্যাহ নেন তিনটি ঋণ, ইমাম হোসেন, তাঁর মা ও স্ত্রী নাসরিনের নামে ছয়টি হিসাবের বিপরীতে ৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা টাকা ঋণ তোলা হয়েছে।
ইমাম হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী কাজে যেতে পারলে তাঁদের ভাত জোটে, না হয় উপোস করতে হয়। তাঁরা কখনো ঋণের জন্য ব্যাংকে যাননি। কীভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়, তাঁরা জানেন না। দুই বছর আগে আহমেদুর রহমান নামে তাঁদের এক প্রতিবেশী করোনাকালে প্রণোদনা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে জনতা ব্যাংকে হিসাব খুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। আহমেদুরের সঙ্গে ব্যাংকে যান তিনি ও তাঁর স্বামী। আহমেদুর ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহর কাছে নিয়ে যান। তখন আবদুল্লাহ তাঁদের বলেন, ‘এ রকম সহায়তা পেতে গেলে জনতা ব্যাংকে হিসাব খুলতে হবে।’ তাঁর কথামতো নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ব্যাংকে হিসাব খোলেন।
অন্য ভুক্তভোগীদেরও একই কায়দায় ব্যাংকে নিয়ে হিসাব খুলিয়ে ঋণগ্রহীতা বানানো হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে যোগসাজশে এসব গায়েবি ঋণ উত্তোলন করেন আহমেদুর রহমান।
রোববার ব্যাংকটির বাড়বকুণ্ড শাখায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নিজ আসনে বসে আছেন। প্রতিবেদক যান ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপক মিটন ঘোষের কক্ষে। সাংবাদিক এসেছেন শুনে আবদুল্লাহ সরে যান। দীর্ঘ সময় পরও তিনি তাঁর আসনে ফেরেননি।
এ বিষয়ে জানতে শাখা ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজুল ইসলামের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। তবে শাখাটির বর্তমান ব্যবস্থাপক মিটন ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যোগদানের পর দেখেন, কিছু গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছেন না। তিনি সেই ঋণ আদায়ে উদ্যোগী হন। প্রথমে তিনি ঋণের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখেন ঋণ নেওয়া যথাযথ হয়েছে কি না। সেখানে দেখতে পান যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। পরে ঋণখেলাপিদের নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঋণখেলাপিদের নোটিশ দিতে গিয়ে অভিযোগ পান। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। কয়েক দিন আগে ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয়। তাঁরা বিষয়টি জানতে এলাকায় যান, মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। এখনো এই ঋণের বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন জমা দেননি দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
নোটিশে ভুক্তভোগীদের প্রত্যেকের নামের বিপরীতে ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে একাধিকবার সরাসরি দেখা করেছেন ও মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। ভুক্তভোগীরা বিষয়টি সুরাহার জন্য বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে যান। পাশাপাশি তাঁরা থানায় লিখিত অভিযোগ দেন।
ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্ল্যাহ মিয়াজি অভিযোগ করেন, আহমেদুর রহমান ও ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মিলে করোনার প্রণোদনার টাকা দেওয়ার কথা বলে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাঁরা চক্রান্ত করে হতদরিদ্র মানুষগুলোকে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা প্রশাসনের মাসিক আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় উত্থাপন করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে আহমেদুর রহমান বলেন, তিনি ঋণগ্রহীতাদের এলাকার মানুষ হিসেবে ঋণের জামিনদার হয়েছেন। এলাকার মানুষ হিসেবে উপকার করতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো টাকা নেননি। এখন যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, বিষয়টি তাঁরা বুঝবেন ও ব্যাংক বুঝবে। যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁদের টাকা যদি তিনি নিতেন, তাহলে তাঁর বাড়িঘর পাকা হতো। অথচ ২০০৯ সাল থেকে নিজের জায়গা বিক্রির টাকায় ঘর তুলতে গিয়ে এখনো কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভায় আলোচনা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলে তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।