ভেড়ামারায় বালুঘাট দখল নিতে অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেলে এসে তাণ্ডব; গুলি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর বালুমহাল দখল নিতে হামলার পরের চিত্র। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার পদ্মা নদীর বালুমহাল দখল নিতে বিএনপির এক নেতার অনুসারীরা দুটি বালুঘাটে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছেন। এ সময় অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেলে শতাধিক ব্যক্তি বালুঘাট দখল নিতে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করেন। আজ মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে ফেরিঘাট বালুমহাল ও মসলেমপুর ১২ মাইল বালুর ঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ১৩টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও ৬টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে সশস্ত্র মহড়া ও তাণ্ডব চলে। এ ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়েছেন। এতে বালু ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম ওরফে আলম মালিথার ক্যাডার হিসেবে পরিচিত রোকনের লোকজন। শতাধিক হামলাকারী মোটরসাইকেল থেকে নেমেই ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে গুলি ছুড়তে থাকেন। বালু ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যাওয়ার পর ওই হামলাকারীরা ব্যাপক তাণ্ডব চালান। এ সময় মোটরসাইকেল ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নৌকা, চেয়ার, টিনের ঘর ভাঙচুর করা হয়।

বাহিরচর ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বালু ব্যবসায়ী সোহেল রানা ওরফে বাবু বলেন, গতকাল সোমবার সকাল থেকে একদল সন্ত্রাসী বালুঘাটে এসে জোর করে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে থাকে। এতে ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁরা ঘোষণা দেন, কোনো সন্ত্রাসীকে অতিরিক্ত চাঁদা তাঁরা দেবেন না। এ নিয়ে আজ মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম ওরফে আলম মালিথার ক্যাডার হিসেবে পরিচিত রোকনের নেতৃত্বে ৭০ থেকে ৮০টি মোটরসাইকেলে শতাধিক সশস্ত্র ব্যক্তি বালুঘাটে প্রবেশ করেই এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করেন। ককটেল ফাটান। এ সময় আটটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও পাঁচটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেন।

অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেলে শতাধিক ব্যক্তি এসে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করেন। হামলার পরের চিত্র। মঙ্গলবার দুপুরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর বালুমহালে
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় বিএনপির নেতা বিপ্লব মালিথা বলেন, নাইন এমএম পিস্তল, শটগান, দোনলা বন্দুকসহ প্রত্যেকের হাতেই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। তাঁরা প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছেন।

ফেরিঘাটের বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ নিয়েই সশস্ত্র এই বাহিনী চলে যায় পাশের ১২ মাইল বালুর ঘাট দখল নিতে। সেখানেও একইভাবে তাণ্ডব চালানো হয়। বালুঘাটে থাকা বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম ওরফে বিশু ও তাঁর ছেলে শামসুজ্জামান সবুজকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁদের খুঁজতে থাকে। সেখানে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি গুলি ছোড়া হয়। এ সময় মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

শামসুজ্জামান সবুজ অভিযোগ করেন, ‘বিএনপি নেতা তৌহিদুল ইসলাম আলমের নির্দেশে তাঁর ক্যাডার রোকন ও উজ্জ্বলের নেতৃত্বে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঘাটে প্রবেশ করে ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। দুজন ব্যবসায়ী আহত হন। আমার মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়।’

ভেড়ামারা থানা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম বিশু জানান, বালুঘাট দখল নিতে সশস্ত্র ক্যাডাররা এই হামলা চালিয়েছে।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর বালুমহাল দখল নিতে হামলার পরের চিত্র। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের ভাতিজা জহুরুল ইসলাম ওরফে বিজলী বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলামের নামে বালুমহাল ইজারা ছিল। টাকা তুলতেন জাকিরুল নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা। এই বালুঘাট দখল নিতে আধিপত্য বিস্তার করতেই রোকনের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী এই হামলা চালায়।

স্থানীয় লোকজন জানান, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম আলম ভেড়ামারা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম ও তিনি আপন ভাই। স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে তাঁরা দুটি পক্ষ। বালুঘাট যাঁরা চালাচ্ছেন, সেখানে তাঁদের ভাতিজাও রয়েছে। ভাতিজা শহিদুল ইসলামের সমর্থক।

অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে খাস আদায় করার জন্য ইজারা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাঁরা অভিযোগ আনছেন, তাঁরাই জোর করে বালুমহাল চালাচ্ছেন। তাঁদেরই কোনো বৈধতা নেই; বরং গত দুই দিনে তাঁরা ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছেন। আমার লোকদের ওপর গুলি করেছেন।’ তৌহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার ৪৭ বছরের রাজনৈতিক জীবন নষ্ট করতেই একদল লোক কাজ করছেন। আমি সবকিছু বৈধভাবে কাজ করছি। এখানে কোনো মহড়া দেওয়া বা অবৈধ পথ অবলম্বন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

ভেড়ামারা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আনোয়ার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তৌহিদুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে ঘাট চালান।

ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, হামলার ঘটনার পর ভেড়ামারা থানার পুলিশের একাধিক দল দুটি বালুর ঘাট এলাকা পরিদর্শন করেছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।