ভাঙা-গড়ার মধ্যেই চলছে ইমরানদের জীবন

বন্যার পানিতে ঘর ডোবার পর আশ্রয় নিয়েছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি কমায় গৃহস্থ বাড়ি ফিরেছেন। আজ সোমবার দুপুরে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরাগাঁও ইউনিয়নের মানাউরা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বছরে বছরে বন্যা হয়। সেই বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় যেতে হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে কিছুদিন থেকে আবার ফিরতে হয় নিজের বাড়িতে। ফিরে এসে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ঘর মেরামত করতে হয়। মেরামতের জন্য পুরোনো ঋণের ওপর আবার নতুন করে ঋণ। আবার পরের বছরের জন্য প্রস্তুতি। মেরামত শেষে আবার সেই বন্যা। এভাবেই চলছে বানভাসিদের জীবন।

বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় পেলেও পানি নেমে যাওয়ার পর কষ্ট বেড়ে যায়। ওই সময় ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য মহাজনদের কাছে গিয়ে ঋণ আনা, তা দিয়ে বাজার থেকে নতুন করে ঢেউটিন, বাঁশ কিনে মেরামত করতে হয়। এর মধ্যে মাসে মাসে মহাজনদের ঋণের টাকা পরিশোধ করা বেশি কষ্টের। কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরাগাঁও ইউনিয়নের মানাউরা গ্রামের বাসিন্দা ইমরান আহমদ (৩০)।

গোয়াইনঘাটের মানাউরা গ্রামে ২৫০টি ঘর আছে। এর মধ্যে এবারের বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৭০টি ঘর। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক ঘর। শুষ্ক মৌসুমে গ্রামটিতে যাওয়া-আসার সড়ক থাকলেও বর্ষায় নৌকাই একমাত্র অবলম্বন।

আজ সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানাউরা গ্রামে অবস্থান করে দেখা যায়, সব কটি বাড়ির চারদিকে পানি আর পানি। উঠানগুলোও এখনো ডুবে আছে। কাঁচা ঘরগুলোর বাঁশের বেড়ার নিচের অংশের মাটি খসে পড়েছে। বাঁশের খুঁটির ঘরগুলো একদিকে হেলে পড়েছে।

ইমরান আহমদের ঘরের সামনে গিয়ে কথা হয় তাঁর স্ত্রী আজিরুন বেগমের (২৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁরা পাঁচ দিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। তাঁর তিন শিশুসন্তানের জ্বর। স্বামী বাজারে গেছেন বাচ্চাদের জন্য ওষুধ কিনতে।

তাঁর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ইমরান ওষুধ নিয়ে ঘরে ফেরেন। এরপর তিনি তাঁর ঘরের ভেতরে নিয়ে সেখানকার চিত্র দেখান। পানিতে কদিন তলিয়ে থাকায় ঘরটির মাটি নরম, স্যাঁতসেঁতে। রান্নাঘরের এক পাশের মাটি ধসে গেছে।

ইমরান বলেন, তাঁর দুই ভাই ও এক বোন এবং মা আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। তিনি ঘর মেরামতের জন্য স্ত্রীকে নিয়ে গতকাল দুপুরে বাড়িতে ফিরেছেন। আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত মেরামতকাজ শুরু করতে পারেননি। বাচ্চাদের অসুস্থতা, আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজখবর নেওয়ার পেছনেই সময় কেটেছে তাঁর। এর মধ্যে কারও কাছ থেকে কোনো ত্রাণসহায়তাও পাননি।

ইমরান আরও বলেন, বন্যায় ঘর ছাড়ার পর ঘরে ফিরে মেরামতের জন্য ঋণ নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঋণ নেওয়ার পর সেটি পরিশোধ করতে দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। এর মধ্যে আবার বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিলে ঋণের ওপর আবার ঋণের বোঝা বইতে হয়।

ইমরানদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মোশাইদ আলীর (৪০) বাড়ি। দুপুরে বাড়ির পেছনে নৌকায় আলকাতরা দিচ্ছিলেন তিনি। তাঁর ঘরের সামনের বেড়ার নিচের অংশের মাটি খসে পড়েছে। ঘরের ভেতরে একটি বিছানা পাতা। সেখানে তাঁর দুই শিশুসন্তান খেলছিল।

মোশাইদ আলী বলেন, তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার। মাছ ধরে সেই আয়েই সংসার চালান। শুষ্ক মৌসুমে অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করেন। বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা পাশের গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গতকাল সবাই বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নৌকা কিনেছেন তিনি। এখন ঘর মেরামতের জন্য কিছু টাকাও আয় করতে হবে। মাছ ধরে যা আয় হবে, সেটি দিয়ে ঋণের টাকা ও ঘর মেরামত করবেন।

মোশাইদ আলীর প্রতিবেশী সুলতানা বেগম বলেন, তাঁদের আশ্রয় নেওয়ার মতো পাশের গ্রামে কোনো স্বজন নেই। ঈদের দিন ঝোড়ো বাতাস ও পানির স্রোত বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। পরে গ্রামের কয়েকজন যুবক নৌকা নিয়ে এসে তাঁদের উদ্ধার করেছেন।

সহায়তা না পাওয়ায় আক্ষেপ

মানাউরা গ্রামের অন্তত ১৫ জন বাসিন্দা জানিয়েছেন, এলাকায় যাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কেউই ত্রাণসহায়তা পাননি। তবে তাঁরা শুনেছেন, জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠরাই সহায়তা নিয়ে যাচ্ছেন, যাঁদের বেশির ভাগই অবস্থাসম্পন্ন।

নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য খালেদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, মানাউরা গ্রামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে চার ধাপে সহযোগিতা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ক্ষতিগ্রস্তদের ১০ কেজি করে চাল, দ্বিতীয় ধাপে শুকনো খাবার, পরবর্তী সময়ে ৫ কেজি করে চাল এবং রোববার আবার ১০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে। অনেকের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছুসংখ্যক না পেয়েও থাকতে পারেন। এরপরও যাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন, তাঁদের খোঁজ নিয়ে তিনি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।