পাবনার বেড়া পৌরসভার দক্ষিণপাড়ার আদনান ডেইরি ফার্মে ১১টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি গাভি। খামারের মালিক আবদুল আউয়াল বলেন, প্রতিটি গাভির খাবারের পেছনে তাঁর প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৫০০ টাকা। প্রতিটি গাভি থেকে গড়ে দৈনিক দুধ পান ছয় থেকে সাত লিটার। প্রতি লিটার দুধ ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে তিনি দৈনিক খরচই তুলতে পারছেন না।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালী, তাড়াশ উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে জড়িত এখানকার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকার ২৫ হাজারের বেশি খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। এ এলাকা থেকে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে খোলা বাজারে বিক্রি করে থাকে।
খামারিরা বলছেন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই হলো খামারিদের দুধ বিক্রি করার প্রধান ভরসা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দুধের সঠিক দাম দিচ্ছে না। এর ওপর চাহিদা কমে যাওয়ার অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনাও কমিয়ে দিয়েছে। খামারিদের ভাষ্য, গোখাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৭০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম দিচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্যাকেটজাত প্রতি লিটার তরল দুধ বিক্রি করছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তারা দুধের বিক্রি মূল্য বাড়িয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। তবে গত এক বছরে খামারি পর্যায়ে সংগ্রহ মূল্য বেড়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ টাকা।
গতকাল বুধবার সকালে সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের ছানার কারখানা সরকার ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায়, খামারিরা সেখানে দুধ নিয়ে ভিড় করেছেন। দুধের দাম দেওয়া হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা লিটার। তা–ও সব খামারির দুধ নেওয়া হচ্ছে না। কারখানাটির ব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল জানান, ছানা তৈরির জন্য আগে আরও বেশি দুধ সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু চাহিদা কমায় এখন প্রতিদিন ৩০ মণ দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে। অনেক খামারি দুধ দিতে চাইলেও সবার দুধ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, বাজারে মৌসুমি ফল থাকে বলে বছরের এই সময়ে দুধের চাহিদা কম থাকে। এ কারণে এখন খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ কিছুটা কমানো হয়েছে। তবে গত রমজান মাসে দাম বাড়িয়েও খামারিদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাওয়া যায়নি। খামারিরা ওই সময়ে ছানা, মাঠা ও ঘোলের কারখানায়, মিষ্টির দোকানে এবং খোলা বাজারে বেশি দামে (৭০ থেকে ৮০ টাকা লিটার) দুধ বিক্রি করেছেন।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু খামারি ছাড়া আর কারও কাছ থেকে দুধ কিনছে না। এমনকি নিজেদের খামারির পুরো দুধও তারা নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে খামারিরা উদ্বৃত্ত দুধ খোলা বাজারে, ছানার কারখানায় কম দামে বিক্রি করছে। খামারিদের দাবি, এতে তাঁদের ব্যাপক লোকসান হচ্ছে।
সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার আওতাধীন সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি বেলায়েত হোসেন জানান, তাঁর সমিতিতে খামারি রয়েছেন ১২৪ জন। প্রতিদিন তাঁদের সমিতিতে ১ হাজার ২০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। অথচ মিল্ক ভিটা কোটা বেঁধে দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে মাত্র ২৫০ লিটার দুধ কিনছে। বাকি দুধ খোলা বাজারে বা ছানা কারখানায় বিক্রি করছেন তাঁরা।
বেড়া উপজেলা ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজা খানম বলেন, গত রমজান মাসে খামারিরা কিছুটা লাভের মুখ দেখেছিলেন। কিন্তু এর আগে ও পরে বিশেষ করে এখন ব্যাপক লোকসান দিতে হচ্ছে। তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন অগ্নিমূল্যের গোখাদ্যের কারণে প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ ৭০ টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে। অথচ দাম পাওয়া যাচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।
আড়ং দুধের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান জানান, পাবনা-সিরাজগঞ্জ থেকে তাঁরা এখন প্রতিদিন ১ লাখ ২০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছেন। দুধের সংগ্রহ মূল্য অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই তাঁরা দিয়ে থাকেন। গত এক বছরে তাঁরা সংগ্রহ মূল্য বাড়িয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত মিল্ক ভিটার বাঘাবাড়ীঘাট দুগ্ধ এলাকার উপমহাব্যবস্থাপক (সমিতি) অমিয় কুমার মন্ডল বলেন, খামারিরা যাতে ভালো থাকেন, সেটাই তাঁদের লক্ষ্য। এ জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। গত বছরের তুলনায় এবার দুধের সংগ্রহ মূল্য প্রায় ১০ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা (চার শতাংশ ননীযুক্ত দুধ) করেছেন। ইতিমধ্যেই গুঁড়া দুধ উৎপাদনের প্ল্যান্ট বসিয়ে পরীক্ষামূলক উৎপাদন করছেন। পুরোদমে এটি চালু হলে প্রতিদিন সেখানে প্রায় তিন লাখ লিটার দুধের প্রয়োজন হবে। ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এটি চালুর কথা রয়েছে। তবে কিছু সমস্যার কারণে পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকা থেকে প্রতিদিন আপাতত ৬০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে।