কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের নির্জন প্যাঁচার দ্বীপ সৈকতে চলছে তিন দিনের সাংস্কৃতিক উৎসব ‘বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল’। প্রতিদিন ১১টি দেশের শতাধিক পর্যটকসহ ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ ব্যতিক্রমধর্মী উৎসব উপভোগ করছেন। সৈকত লাগোয়া পরিবেশবান্ধব ইকোটুরিজম প্রতিষ্ঠান ‘মারমেইড বিচ রিসোর্ট’–এর আঙিনায় চলছে বর্ণিল এই উৎসব। যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক রক সিটির ‘বার্নিং ম্যান প্রজেক্টের’ আদলে সাজানো হয় মারমেইডের এই আয়োজন। কক্সবাজারের পর্যটনের প্রসার এবং বিশ্বদরবারে কক্সবাজারের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিতেই বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করছে মারমেইড ইকোটুরিজম লিমিটেড।
গতকাল বুধবার বিকেল পাঁচটা থেকে শুরু হওয়া ক্র্যাব ফেস্টিভ্যালের আজ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিন গড়াচ্ছে। রিসোর্টের বিশাল জায়গার চারপাশ ও মধ্যভাগে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে তৈরি হয় পৃথক ছয়টি মঞ্চ। সেসব মঞ্চে একসঙ্গে চলছে লালন, বাউলগান থেকে শুরু করে হাল আমলের জনপ্রিয় ডিজে আর আদিবাসী রাখাইন, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের নৃত্যগান। অন্ধকার রাতে চলছে দৃষ্টিনন্দন ফায়ার শো, সমুদ্রের পানিতে ভাসমান নৌকার বোট শোসহ নানা পরিবেশনা।
মারমেইড রিসোর্টের পশ্চিমাংশে রয়েছে ৩০০ ফুট লম্বা দৃষ্টিনন্দন একটি সুইমিংপুল। পুলের পাশ ঘেঁষে গাছপালায় ঘেরা রেস্তোরাঁ। সেখানে বসানো হয় চেয়ার। গাছের নিচে কিংবা চেয়ারে বসে খেতে খেতে অনেকে উৎসব উপভোগ করছেন। সুইমিংপুলের পশ্চিম পাশে খোলা মাঠে তৈরি হয় বিশাল আকৃতির ‘লাল কাঁকড়া’ মঞ্চ। বিকেল পাঁচটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মঞ্চে উঠে ডিজে পরিবেশন করেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, থাইল্যান্ড থেকে আসা শিল্পীরা।
কাঁকড়াসদৃশ মঞ্চ তৈরির কারণ তুলে ধরেন মারমেইড ইকোটুরিজম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সব জায়গায় লাল কাঁকড়ার ঝাঁক দেখা যেত। এখন প্যাঁচার দ্বীপ সৈকত ছাড়া কোথাও তেমন লাল কাঁকড়া দেখা যায় না। পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখা প্রাণী এই লাল কাঁকড়া মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। লাল কাঁকড়ার প্রতি মানুষকে সচেতন করতেই উৎসবে কাঁকড়াসদৃশ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।
কাঁকড়া মঞ্চের পেছনে এবং সৈকতে নামার প্রবেশমুখের কাঠের সেতুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মরা গাছ। গাছে ঝুলছে ১০-১৫টি ঘড়ি, প্লাস্টিকের বোতল ও কিছু অকেজো যন্ত্রপাতি। এই প্রদর্শনীর নাম রাখা হয়েছে ‘দেহঘড়ি’। এটি নির্মাণ করেন ভাস্কর রনি আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসা পানির বোতল, গাছের গুঁড়ি, মাছ ধরার ছেঁড়া জাল, যেগুলো মানুষ ফেলে দিয়েছিলেন সেগুলো এবং মারমেইড রিসোর্টের ভেঙে যাওয়া (নষ্ট) জিনিসপত্র দিয়ে দেহঘড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি দেখে মানুষ প্রকৃতিকে বুঝবেন এবং নিজের দেহ সম্পর্কে যত্নশীল হবেন। মানুষের দেহের মধ্যে এ রকম জটিল জিনিসপত্র আছে, দেহঘড়ির মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সুইমিংপুলের পূর্ব পাশে অনেক আগেই তৈরি হয়েছে বিশাল আকৃতির কাছিমের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি লম্বায় ৬৮, প্রস্থে ৩৫ ও উচ্চতায় ১৮ ফুট। সমুদ্রসৈকত থেকে কুড়িয়ে আনা ভাঙা কাচের আয়না, প্লাস্টিক টুকরা, ভাঙা টাইলস—এসব দিয়ে কচ্ছপের ওপরে প্রলেপ তৈরি করা হয়। এই ভাস্কর্যও তৈরি করেন শিল্পী রনি আহমেদ।
রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল হক চৌধুরী বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্রসৈকতে শীত মৌসুমে শত শত কাছিম ডিম পাড়তে আসে। কিন্তু সাগরে পুঁতে রাখা জালে আটকা পড়ে বহু কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া জেলেরা পিটিয়েও মা কাছিম হত্যা করছেন। অথচ নিরীহ এই প্রাণী মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। এরা সমুদ্রের পরিবেশ রক্ষা করে। কাছিম সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে।
এবারের বার্নিং ফেস্টিভ্যালে কাছিম ভাস্কর্য ঘিরে ‘কসমিক টার্টল’ মঞ্চ সাজানো হয়েছে। সেখানেও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা চলছে। আছে ‘ক্র্যাব ড্রিমার’ ও ‘বিগ ব্যাং’ নামে আরও দুটি মঞ্চ। সবই পরিবেশবান্ধব এবং কুড়িয়ে আনা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়।
দর্শনার্থীদের বেশি নজর কাড়ছে বালুচরে স্থাপিত ডিম আকৃতির ‘এগ প্রানেট’ মঞ্চ। মঞ্চের পেছনে বিশাল মাঠে সাজানো হয় শত শত লাইট। রাতের বেলায় রকমারি লাইটের আলো অন্য রকম আমেজ তৈরি করছে। ডিম ভাস্কর্যটি তৈরি হয়ে সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসা প্লাস্টিক ও পুরোনো কাঠ-বাঁশ দিয়ে। পুরো আয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে বিদ্যুতের শতাধিক পুরোনো খুঁটি। যা দেখতেও অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল। উৎসবের কিউরেটর জাপানি ফেস্টিভ্যাল আর্কিটেক্ট এবং লাইটিং ডিজাইনার জিরো এন্দো। ঘুরে ঘুরে তিনি সবকিছু তদারক করছিলেন।
সৈকতের ঝাউবাগানের ভেতরে লাগানো হয় নানা প্রতিকৃতির বিলবোর্ড। অন্ধকারের বৈদ্যুতিক আলোতে ঝলমল প্রতিকৃতিগুলো যেন দর্শনার্থীদের পরিবেশ রক্ষার কথাই স্মরণ করে দিচ্ছে।
দিনের চেয়ে রাতের উৎসব জমজমাট
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে উৎসব আরও জমজমাট হয়ে ওঠে। মারমেইড রিসোর্টের ৩০০ ফুট লম্বা সুইমিংপুলের পশ্চিম পাশের মাঠে তৈরি কাঁকড়া মঞ্চে আদিবাসী তরুণ–তরুণীদের নৃত্যগান উপভোগ করেন বিদেশিরা। উৎসবে অংশ নেওয়া জাপান, থাইল্যান্ড ও ভুটানের কয়েকজন পর্যটক জানালেন, রাতের আয়োজন তাঁদের কাছে উপভোগ্য মনে হয়েছে। বিভিন্ন মঞ্চে ডিজে পরিবেশন করেন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিল্পীরা।
ভিয়েতনাম থেকে আসা লেম দাউ নামের এক তরুণ পর্যটক বলেন, তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছেন। বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যালের কথা শুনে তিনি ঢাকা থেকে মারমেইডে ছুটে এসেছেন। সাগরতীরের এই ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল দারুণ উপভোগ্য হচ্ছে। দিনের চেয়ে রাতের আয়োজন জমজমাট হচ্ছে। শেষ দিনেও তিনি বালুচরে দাঁড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্ত উপভোগ এবং আনন্দ–উল্লাসে উৎসব শেষ করতে চান।
আজ সন্ধ্যায় অন্যান্য পরিবেশনার পাশাপাশি প্রদর্শিত হয়েছে এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব বুসানের সেরা পুরস্কারজয়ী সিনেমা ‘বলী: দ্য রেসলার’। চট্টগ্রামের বলীখেলার ঐতিহ্য আর সাগরপাড়ের লোকগাথা মিলিয়ে এই চলচ্চিত্র। সাগরপাড়ে বসেই দেখছেন সাগরপাড়ে তৈরি সিনেমাটি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেন নাসির উদ্দিন খান, এ কে এম ইতমাম, প্রিয়াম, অ্যানজেল নুর, তাহাদিল আহমেদ ও তানভীর আহমেদ।