এখনই বৃষ্টি চান না নওগাঁর ধানচাষিরা, আর বৃষ্টির জন্য হাহাকার আমচাষিদের

নওগাঁয় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার সদর উপজেলার দিঘলীর বিলে শৈলগাছী মধ্যপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। গরম থেকে রেহাই পেতে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ আদায় ও প্রার্থনা করছে মানুষ। তবে এ মুহূর্তে বৃষ্টি চান না নওগাঁর ধানচাষিরা। কারণ, মাঠে পাকতে শুরু করেছে ধান। এখন বৃষ্টি হলে ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই রোদে পুড়ে ধান কাটতে কষ্ট হলেও এই মুহূর্তে বৃষ্টি চান না তাঁরা।

তবে বিপরীত চিত্র আমচাষিদের ক্ষেত্রে। দাবদাহের কারণে আমের গুটি ঝরে পড়া ঠেকাতে বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছেন আমচাষিরা।

কৃষি বিভাগের ভাষ্য, এবার বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। নির্বিঘ্নেœমাঠের ফসল কৃষকের গোলায় তুলতে পারলে নওগাঁয় ১২ লাখ ৫৬ হাজার ২১৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে, যার বাজার মূল্য সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি থেকে এ বছর ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর জেলায় ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৯৫ হেক্টর বেশি। গত শুক্রবার পর্যন্ত জেলায় ৪ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। এবার বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ২২-২৪ মণ করে ধানের ফলন পাওয়া যাচ্ছে।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই জেলার অর্থনীতি মূলত ধাননির্ভর। এই জেলায় প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে বছরে দুবার ধান আবাদ হয়ে থাকে। আমন ধানের চেয়ে বোরো ধান চাষে কৃষকের শ্রম ও খরচ বেশি হয়। শ্রমে-ঘামে জমিতে ফলানো সোনার ধান গোলায় না ওঠা পর্যন্ত কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ থেকে যায়।

নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ও দুবলহাটি ইউনিয়নের প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের কৃষিজমি রয়েছে দিঘলীর বিলে। এই বিলের প্রায় ৮০ শতাংশ খেতের ধান পেকে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ধান কাটা-মাড়াই। শুধু দিঘলীর বিল নয়, নওগাঁর আত্রাই, রানীনগর ও মান্দা উপজেলার নিচু এলাকায় শুরু হয়েছে ধান কাটা-মাড়াই উৎসব। আবহাওয়া ভালো থাকলে নওগাঁয় ধান কাটা-মাড়াই শেষ হতে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে।

গতকাল শনিবার দিঘলীর বিলে গিয়ে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদ ও ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে কৃষকেরা ধান কাটছেন। বিলের উঁচু জমিতে খলা করে সেখানেই মাঠের কাটা ধানের আঁটি এনে স্তূপ করছেন কেউ কেউ। আবার কোথাও ধান মাড়াই ও খড় শুকানোর ব্যস্ত কিষান-কিষানিরা।

বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ সালে বিলে ধান কাটার মৌসুমে ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। ওইবার প্রায় ৩০ শতাংশ ধান মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টিভেজা যেটুকু ধান ঘরে তুলতে পেরেছিলেন, তা কম দামে বিক্রি করতে হয়েছিল। তবে গত বছর নির্বিঘ্নে ধান ঘরে তুলেছেন। এবার সামনে ২০ থেকে ২৫ দিন ঝড়বৃষ্টি না হলে ভালোভাবে মাঠের ধান ঘরে তুলতে পারবেন তাঁরা।

আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করতে বাগানে সেচ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি নওগাঁর সাপাহার উপজেলার গোডাউন পাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁ পৌরসভার আরজি-নওগাঁ এলাকার বাসিন্দা আবদুল খালেক এ বছর ১৬ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার সব জমিই দিঘলীর বিলে। খেতের ধান পাকতে শুরু করেছে। ১৬ বিঘা জমির মধ্যে ২ বিঘা জমির ধান কাটা হয়েছে। বাকি ধান ঘরে না ওঠা পর্যন্ত আমার স্বস্তি পাচ্ছি না। মাঠে ধান পেকে আছে—এমন সময় কোনো চাষিই চাইবে না ঝড় কিংবা বৃষ্টি হোক। এই সময় ভারী বৃষ্টি হলে নিচু এলাকার ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার ঝড় হলে পাকা ধান ঝরে পড়ে ক্ষতি হয়। তাই পাকা ধান মাঠে থাকা অবস্থায় বৃষ্টি না হওয়াই ভালো। প্রচণ্ড রোদে ধান কাটা-মাড়াই করতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ধান ঘরে উঠলে সেই কষ্ট আর থাকবে না।’

দুবলহাটি গ্রামের কৃষক জাহিদুর রহমান বলেন, ‘কয়েকটা দিন বৃষ্টি যাতে না হয়, আমরা সেই প্রার্থনা করছি। মাঠের প্রায় সব ধান পেকে আছে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি হলে ধান কাটা-মাড়াইয়ে ভোগান্তি হবে। ধান কাটা-মাড়াইয়ের সময় রোদ থাকাই ভালো। মাঠ শুষ্ক থাকলে ট্রাক্টর কিংবা ভ্যানে করে মাঠের ধান ঘরে তোলা যায়। আর বৃষ্টি হলে ধান মাথায় কিংবা ভারে করে বহন করে ধান তুলে আনতে হয়। সব মিলিয়ে ধান কাটা-মাড়াইয়ের সময় বৃষ্টি না হওয়াই ভালো।’

কয়েকটা দিন বৃষ্টি যাতে না হয়, আমরা সেই প্রার্থনা করছি। মাঠের প্রায় সব ধান পেকে আছে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি হলে ধান কাটা-মাড়াইয়ে ভোগান্তি হবে।
জাহিদুর রহমান, দুবলহাটি গ্রামের কৃষক

অন্যদিকে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছে আমচাষিরা। দীর্ঘ খরার কারণে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করতে কৃষি বিভাগের পরামর্শে আমবাগানে ঢালা সেচ ও গাছে পানি ছিটাচ্ছেন আমচাষিরা। তবে শুষ্ক এলাকা হিসেবে পরিচিত নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলার অনেক এলাকায় সেচসুবিধা না থাকায় বাগানের আম ঝরে পড়া রোধ করতে পারছেন না চাষিরা। এ পরিস্থিতিতে বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছেন ওই সব এলাকার আমচাষিরা।

পোরশা উপজেলার ছাওড় ইউনিয়নের নোচনাহার গ্রামের আমচাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘খরায় গাছের আমের গুটি ঝরে পড়ছে। বাগানে ঢালা সেচ দেব—এমন সুবিধা নেই। তাই আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করতে দূর থেকে পানি এনে মেশিনের সাহায্যে গাছে পানি ছিটাচ্ছি। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি খুবই দরকার।’

আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করতে দূর থেকে পানি এনে মেশিনের সাহায্যে গাছে পানি ছিটাচ্ছি। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি খুবই দরকার।
জাহাঙ্গীর আলম, পোরশা উপজেলার নোচনাহার গ্রামের আমচাষি

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, নওগাঁয় প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে দাবদাহ চলছে। এই পরিস্থিতি ধানচাষিদের জন্য ভালো। আর ২০ থেকে ২৫ দিন ভারী বৃষ্টি বা ঝড় না হলে নির্বিঘ্নে মাঠ থেকে ধান উঠে আসবে। তবে এই মুহূর্তে হালকা বৃষ্টি হলে ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। পাশাপাশি আম, লিচুসহ অন্যান্য মৌসুমি ফল চাষের জন্য খুব উপকার হতো। খরার কারণে আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।