এক শর্ষে তিন রকম আয়, পাঁচ গুণ বেড়েছে চাষ

গত বছর তিন বিঘা জমিতে শর্ষে চাষ করেছিলেন কৃষক মো. সুজাউল হক। ভালো লাভ হ্য়্ওয়ায় এবার নয় বিঘা জমিতে এই ফসলের আবাদ করেছেন তিনি। গতকাল সকাল দশটায় মিরসরাইয়ের মঘাদিয়া মাস্টারপাড়া এলাকা থেকে তোলাছবি: ইকবাল হোসেন।

বছর দশেক আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা মো. মাসুদ করিম চৌধুরী। কারখানা ভালো না চলায় বছর কয়েক চাকরি করেই ছাড়তে হয়। পরে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেও চাকরি হয়নি। তাই পৈতৃক জমিতে কৃষিকাজ শুরু করেন। বিভিন্ন কৃষকের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবার তিনি প্রথমবারের মতো শর্ষে চাষ শুরু করেছেন।

মো. মাসুদ করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির জন্য বসে থাকেননি তিনি। চেষ্টা করেও চাকরি না হওয়ায় কৃষিকাজ শুরু করেন। বিভিন্ন ফসলের চাষ করতেন। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কৃষকেরা শর্ষে চাষ করে লাভবান হয়েছেন। বিষয়টি তাঁকে উৎসাহিত করেছে। তাই এবার তিনি সাত গন্ডা জমিতে শর্ষের বীজ ফেলেছেন। সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

মাসুদ জানান, বর্তমানে শর্ষের ফুল উঠেছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফসল কাটা শুরু হবে। এতে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উঠে আসবে। এই এক ফসলে তিনভাবে আয় করা যায়। যেমন তেল, খৈল ও দানা বিক্রি করা যায়। এ কারণে অনেক কৃষক ও উদ্যোক্তা শর্ষে চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

মাসুদ একা নন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় তাঁর মতো আরও প্রায় ২৫ হাজার কৃষক এ বছর শর্ষে চাষ করেছেন। বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামে শর্ষের আবাদি জমির পরিমাণ পাঁচ গুণ বেড়েছে। এতে উৎপাদন দুই থেকে তিন গুণ বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে কৃষকেরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি স্থানীয় কৃষকের তৈরি শর্ষের তেলের দামও কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ফটিকছড়ির জাফরনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সেলিম উদ্দিন এবার প্রায় ১৫ কানি জমিতে শর্ষে চাষ করছেন। গত রবি মৌসুমে একই জমিতে শর্ষের চাষ করে তিনি আড়াই লাখ টাকা আয় করেছিলেন। এবার আরও বেশি আয় হবে বলে জানালেন এ কৃষক। সেলিম বলেন, ‘শর্ষের চাষে মুনাফা বেশি, পরিশ্রম কম। এবার তিন লাখ টাকা পার হবে বলে আশা করছি।’

জানা গেছে, বছরের ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুম। এ মৌসুমে সাধারণত বোরো ধান, শীতকালীন সবজি, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন তেল ও ডালজাতীয় ফসলের উৎপাদন হয়। ১ লাখ ৫৭ হাজার ৩৫৮ হেক্টর জমিতে এসব চাষ করেন কৃষকেরা। চট্টগ্রামের প্রায় সব উপজেলায় শর্ষের চাষ হচ্ছে।

সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বীজ বপন শুরু হয়, যা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। আর শর্ষে সংগ্রহ শুরু হয় ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে। শেষ হয় মার্চের মাঝামাঝিতে। এরপর শুরু হয় বিক্রির কার্যক্রম। তবে এ বছর বৃষ্টির কারণে দেরিতে বীজ রোপণ করতে হয়েছে কৃষকদের। এ কারণে ফসল সংগ্রহ শুরু হবে মার্চের প্রথম দিকে।

তবে পানির অভাবে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডের কৃষকেরা বিপাকে আছেন। মিরসরাইয়ের বাসিন্দা মো. আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেচের অভাবে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছে। আমরা অনেক বিপদে আছি। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করা হলে শর্ষের উৎপাদনও বাড়বে।’

লাভ বেশি, বাড়ছে উৎপাদন

রাউজান উপজেলার ৩ নম্বর চিকদাইর ইউনিয়নের বাসিন্দা কৃষি উদ্যোক্তা মো. হানিফ মিয়া শর্ষে চাষে লাভের হিসাব তুলে ধরেন এ প্রতিবেদকের কাছে। তিনি এ বছর ১৫ কানি জমিতে শর্ষে চাষ করছেন। সব মিলিয়ে ছয় হাজার কেজি শর্ষে উঠে আসবে। হানিফ জানান, শর্ষে থেকে তেল, খৈল, দানা—এই তিন ধরনের পণ্য তিনি বিক্রি করেন। প্রতি কানি জমিতে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে বিনিয়োগ করেছেন। প্রতি কানিতে উঠে আসবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। বাজারে খৈল বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। তেল বিক্রি হয় প্রায় ৩৫০ টাকায়। এ ছাড়া শর্ষের দানা বিক্রি হয় কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। এক কেজি শর্ষে থেকে ৩০০ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। ফলে তিন রকমভাবে আয় করা যায়।

মূলত তিনভাবে আয় করার সুযোগ থাকায় কৃষকেরা শর্ষে চাষের দিকে ঝুঁকছেন। রাউজানের বাসিন্দা মোহাম্মদ সোলাইমান বছর ছয়েক আগে চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ শুরু করেন। বর্গা নেওয়া জমিতে চাষ করছেন তিনি। আগে ধান, গম ও বিভিন্ন প্রকারের সবজির চাষ করেছেন। এই মৌসুমে প্রথমবারের মতো দুই কানি জমিতে শর্ষের চাষ করছেন তিনি। সোলাইমান প্রথম আলোকে বলেন, গম, ভুট্টা কিংবা অন্যান্য সবজির চাষে পরিশ্রম বেশি হয়। বিনিয়োগও বেশি করতে হয়। কিন্তু শর্ষে চাষে পরিশ্রম কম করেও বাড়তি টাকা লাভ হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯-২০ মৌসুমে চট্টগ্রাম জেলায় মাত্র ৬০২ হেক্টর জমিতে শর্ষের আবাদ হয়েছিল। ওই মৌসুমে উৎপাদন হয় ৭৪৩ মেট্রিক টন। পরের ২০২০-২১ মৌসুমে ৭৫৮ হেক্টর জমিতে ৯৩২ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ মৌসুমে ৭১১ হেক্টর জমিতে ৮৫৪ মেট্রিক টন শর্ষে উৎপাদন হয়।

এরপর গত ২০২২-২৩ মৌসুমে আবাদি জমি ও উৎপাদনে বড় পরিবর্তন আসে। এই মৌসুমে ২ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ৫৭৬ মেট্রিক টন শর্ষে উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে

৩ হাজার ৯৮৭ হেক্টর জমিতে শর্ষে চাষ হচ্ছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন। ফলে গত পাঁচ বছরের তুলনায় উৎপাদন বাড়ছে ৬ গুণ।

শর্ষের উৎপাদন ভালো হওয়ার ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ভোজ্যতেল ফসলের আবাদ বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের প্রণোদনা, বিনা মূল্যে শর্ষের বীজ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কৃষকেরাও শর্ষে চাষে আগ্রহী হয়েছেন। এসব কারণে এবার উৎপাদন বেশি হয়েছে। কৃষকের মুখে হাসি ফুটছে।