মৌলভীবাজারে হাকালুকি হাওরপারের মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে
পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে টইটম্বুর এখন হাকালুকি হাওর। উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে হাওরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পানি বেড়ে যাওয়ায় হাওরপারের গ্রামগুলো ক্রমে ডুবছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। মানুষজন ঘরবাড়িতে টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করছে। টিকতে না পেরে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছে।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ২৫২টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় সাড়ে ৪০০ পরিবারের বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এতে এসব গ্রামের মানুষেরা নিজেদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেও গরু-ছাগল নিয়ে অনেকে সংকটে পড়েছেন।
এদিকে মৌলভীবাজারের প্রধান নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টিও কিছুটা কমে এসেছে। মনু ও ধলাই নদে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও আজ শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল আজ প্রথম আলোকে বলেন, নদ-নদীর পানি কমছে। আপাতত ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস নেই।
বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের আজিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছিদ্দেক আলী উচ্চবিদ্যালয় দুটি আশ্রয়কেন্দ্র পাশাপাশি। সেখানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৮৩টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় মানুষের সঙ্গে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিও ঠাঁই নিয়েছে। অনেকে রান্নাবান্না করছেন। এই দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া বেশির ভাগ মানুষই সুজানগর ইউনিয়নের হাওরসংলগ্ন ভোলারকান্দি গ্রামের। গ্রামের চারপাশে এখন থই থই করছে হাওরের পানি।
বন্যাদুর্গতরা জানিয়েছেন, প্রায় সব বাড়িতেই পানি উঠেছে। অনেকে বাড়িতে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন। বাড়িঘর ঢেউয়ের কবলে পড়েছে। অনেকের ঘর, ভিটেমাটি হাওরের বিশাল ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে।
সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি গ্রামের মাসুক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুব কষ্টের বিনিময়ে হাতরাইয়া আইয়া (সাঁতার কেটে এসে) স্কুলও উঠছি। এখন গরুও রাখছি অনো (এখানে)। বাড়িঘরর অবস্থা খারাপ। ঘরর (বাড়িতে) ভিতর কমর (কোমর) সমান পানি। ধান থইয়া আইছি (রেখে আসছি)। কিন্তু খানিবনি কুনতাও দেওয়া যার না (গরুরে খাদ্য দেওয়া যাচ্ছে না)। নৌকা থাকলে না অয় (হয়) ঘাসফাস আনিয়া (এনে) দিতাম।’
ভোলারকান্দি গ্রামের হালিমা বেগম বলেন, ‘ঘরের ভিতর টিকতাম পারছি না। আটু (হাঁটু) পানি। ঈদর পরদিন আইছি (আসছি)।’
ভোলারকান্দির মুসলিম আলী নিজের অবস্থার চেয়ে বেশি চিন্তিত গবাদিপশু নিয়ে। তিনি বলেন, ‘গরুর অবস্থা ভালা নায়। থুবাই-থাবাই (এদিক-ওদিক থেকে সংগ্রহ করে) ঘাস, পেনা (কচুরিপানা) আনি (এনে) খাওয়াইরাম। পেনা মিলের না। খাইতোও চায় না। কিন্তু কিতা (কি) করব। ঠেকিয়া খাইতো অইবো (খেতে হবে)।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘরে পানি উঠছে। ঈদের পরর দিন আইয়া (এসে) উঠছি। ঘর একখান আফালে ভাঙিয়া নিচেগি (ঘর একটা ঢেউয়ে ভেঙে নিয়েছে)।’
একই গ্রামের হামিদা খাতুন বলেন, ‘ঘরও আটু (হাঁটু) পানি। হুরুত্বা-ছাবাল লইয়া থাকতাম পারছি না (বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে পারিনি)। পানিত পড়িয়া পাঁচটা ছাগল মরছে।’
সুজানগর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় ভবনের কাছে পানি চলে এসেছে। ইউনিয়নের আজিমগঞ্জ বাজারেও পানি উঠেছে। বাজারের আশপাশের গ্রামের মানুষ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকে নৌকা নিয়ে চলাচল করছেন।
সুজানগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বদরুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তাঘাট সব পানির নিচে। কমবেশি ইউনিয়নের সব গ্রামেই পানি। এখনো পানি বাড়ছে। সবচেয়ে বড় সংকট মানুষের কর্মসংস্থান নেই। গরু-ছাগল নিয়ে বিরাট সমস্যা।’ ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, তাঁর ইউনিয়নের চারটি কেন্দ্রে ১১৩টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসন থেকে ঈদের সময় পাঁচ টন এবং পরে আরও সাত টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একই অবস্থা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের। গ্রামগুলোর রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। নৌকা ছাড়া চলাচলের সুযোগ নেই। অনেকের নৌকা না থাকায় তারা ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে। উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের বড় ময়দান এলাকাতেও দেখা গেছে, অনেক বাড়িঘরে পানি উঠেছে। লোকজন বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত বড়লেখা উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নের ২৫২টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। ৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪৪৭টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাকবলিতদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৫০ টন চাল বরাদ্দের পাশাপাশি রান্না করা ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।