যশোরে যুবলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা, একনিমেষেই ‘উৎসব ভবন’ ছেয়ে গেল বিষাদে

দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত যুবলীগ নেতা উদয় শংকর বিশ্বাসের বাড়িতে লোকজনের ভিড়। সোমবার বিকেলে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পাঁচাকড়ি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পাকা সড়কের পাশে দোতলা বাড়ি। হরেক রকমের গাছগাছালিতে ঠাসা। বাড়ির নাম ‘উৎসব ভবন’। বাড়ির এক পাশে পুকুর। সোমবার সকাল থেকে বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা নেই। শুধু মানুষ আর মানুষ। তাঁরা সবাই এসেছেন শোক জানাতে। বাড়ির একমাত্র ছেলে উদয় শংকর বিশ্বাস (৪৩) দুর্বৃত্তদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। ‘উৎসব ভবন’ ছেয়ে গেছে বিষাদে। উদয় শংকরের স্বজনদের আহাজারি যেন থামছে না।

উদয় শংকর বিশ্বাসের বাড়ি মনিরামপুর উপজেলার পাঁচাকড়ি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের রণজিৎ বিশ্বাসের ছেলে। উদয় মনিরামপুর উপজেলার নেহালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সংস্কৃতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। তিনি নেহালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ছাড়া তিনি পাঁচাকড়ি টেকারঘাট বালিকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন।

সোমবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বাজার করে মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে ঢোকার সময় দুর্বৃত্তরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

বিকেলে পাঁচাকড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় মাঝখানে বৈকালী এলাকা। পাশ দিয়ে চলে গেছে নওয়াপাড়া-কালিবাড়ি সড়ক। বৈকালী এলাকায় পাঁচ-ছয়টি দোকান। এর মধ্যে তিনটি চায়ের দোকান। বৈকালী থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে সড়কের পাশে একটি পুকুর। পুকুরপাড়ে একটি দোতলা বাড়ি। এই পুকুরের পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয় উদয় শংকরকে।

বাড়ির নিচতলার বারান্দায় বসে অঝোরে কাঁদছিলেন উদয় শংকর বিশ্বাসের মা ছবি রানী বিশ্বাস (৬৫)। ঘরের একটি কক্ষে ছিলেন স্ত্রী অনিন্দিতা বিশ্বাস (৩৮) এবং একমাত্র ছেলে উৎসব বিশ্বাস (১০)। কেউ কোনো কথা বলছেন না। মাঝেমধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠছেন অনিন্দিতা।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেল পৌনে চারটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ বাড়িতে আনা হয়। এ সময় বাড়িতে মাতম শুরু হয়। উঠানে শুইয়ে রাখা ছেলের লাশের পাশে বসে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন মা ছবি রানী বিশ্বাস। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শেষকৃত্যের জন্য লাশ টেকারঘাট মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।

উদয় শংকর বিশ্বাসের মা ছবি রানী বিশ্বাসের আহাজারি থামছে না
ছবি: প্রথম আলো

উদয় শংকর বিশ্বাসের কাকা সুজন বিশ্বাস জানান, সকালে উদয় বাজার করতে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে টেকারঘাট বাজারে যান। বাজার শেষে মোটরসাইকেলে করে তিনি নওয়াপাড়া-কালীবাড়ি সড়ক দিয়ে পাঁচাকড়ি গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তিনি বাড়ির সামনে বৈকালী এলাকায় পৌঁছান। সেখান থেকে কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে পেছন দিক থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এতে তিনি রাস্তার ওপর পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান।

পাঁচাকড়ি গ্রামের বৈকালী এলাকার চায়ের দোকানি দশরথ মণ্ডল বলেন, দুই ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেলে করে এসে দোকানে বসেন। তাঁরা দুজনে দুই কাপ চান খান। চায়ের দাম দিয়ে তাঁরা দোকানের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন। এরপর তাঁরা বাসুদেব চক্রবর্তীর চায়ের দোকানের দিকে চলে যান।

বাসুদেব চক্রবর্তী বলেন, সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোটরসাইকেলে করে দুই ব্যক্তি বৈকালী এলাকায় তাঁর দোকানের সামনে এসে থামেন। তাঁদের একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। অপরজনের মাথায় হেলমেট ছিল না। তাঁরা দোকান থেকে দুটি সিগারেট কিনে নিয়ে চলে যান। এর খানিকটা পর সাইকেলের চাকা বার্স্টের মতো একটি শব্দ হয়। শব্দ শুনে তাঁরা সেখানে দৌড়ে যেতে যেতে ওই দুই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান। তাঁরা এগিয়ে দেখেন, বাড়ি ঢোকার মুখে পুকুরপাড়ে সড়কের পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে উদয় শংকর মাটিতে পড়ে রয়েছেন।

আরও পড়ুন

স্থানীয় লোকজন বলেন, তিন মাস আগে উপজেলার পাঁচাকড়ি টেকারঘাট বালিকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হন উদয় শংকর বিশ্বাস। ১৫ দিন আগে বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লেনদেন হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

মনিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, উদয় শংকর বিশ্বাসকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পেছন দিক থেকে তাঁকে গুলি করা হতে পারে। একটি গুলি তাঁর শরীরে লেগেছে। এলাকায় উদয় শংকর বিশ্বাসের কোনো শক্র ছিল না। বিদ্যালয়ের নিয়োগকে কেন্দ্র করে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মামলা প্রক্রিয়াধীন।