বছর কয়েক আগেও রাজধানী ঢাকা থেকে শরীয়তপুরের মানুষের যাতায়াত ছিল নৌপথনির্ভর। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর জেলার নৌপথের যাত্রীদের অনেকে বাসমুখী হলেও লঞ্চের কদর একেবারে কমে যায়নি। মহাসড়কে বাসের ঝক্কিঝামেলা এড়াতে চলাচলের বদলে এখনো অনেকে বেছে নেন স্বস্তির নৌপথ।
লঞ্চের মালিক, শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নৌপথে ঢাকার সঙ্গে পদ্মা নদীঘেঁষা শরীয়তপুরের মানুষের যাতায়াতের ইতিহাস বহু বছরের। শুরুর দিকে নৌকায়, তারপর স্টিমারে, এরপর অন্তত ৭০ বছর ধরে লঞ্চে চলছে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন।
নড়িয়ার চাকধ এলাকার মোবারক হোসেন পরিবার নিয়ে ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায় থাকেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকার সদরঘাট থেকে বেলা একটায় লঞ্চে রওনা হয়ে সন্ধ্যা ছয়টায় মুলফৎগঞ্জ ঘাটে পৌঁছান। মোবারক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জন্য সহজ ও নিরাপদ যানবাহন হচ্ছে লঞ্চ। ঝক্কিঝামেলা ছাড়া লঞ্চে করে পরিবারের সঙ্গে গল্প করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছে যাই। বাসে খরচ ও ঝামেলা বেশি। তাই আমরা নৌপথে লঞ্চে চলাচলেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।’
শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম একেবারে পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। সব মিলিয়ে পুরো জেলার মানুষের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে যাতায়াত করতে নৌপথ ব্যবহার করতে হতো। ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নৌপথে যাত্রীর যাতায়াত অনেকটা কমেছে। শরীয়তপুরের নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোসাইরহাট থেকে ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে ৫০-৬০টি লঞ্চ চলাচল করত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর তা কমে ১০-১৫টিতে নেমে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে নড়িয়া উপজেলা সদর থেকে চারটি লঞ্চ ঢাকায়, দুটি নারায়ণগঞ্জে ও দুটি চাঁদপুরে যাতায়াত করছে। ডামুড্যা ও গোসাইরহাট থেকে দুটি লঞ্চ ঢাকার সদরঘাটে চলাচল করছে। অন্য উপজেলার সঙ্গে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বলা চলে, শুধু পদ্মার নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা যাতায়াত এবং ওই এলাকার হাটবাজারের মালামাল পরিবহনের জন্য লঞ্চ ব্যবহার করেন।
গত শুক্রবার সকাল থেকে ঈদে ঘরমুখী মানুষের চাপ বাড়ে লঞ্চে। ওই দিন থেকে লঞ্চে চড়ে পদ্মাপারের মানুষেরা ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরতে শুরু করেন। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সকালে, দুপুরে ও রাতে নড়িয়ার উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে আসে। আবার সকাল, দুপুর ও রাতে নড়িয়া থেকে সদরঘাটের উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে যায়। ডামুড্যা ও গোসাইরহাট থেকে রাতে এবং ঢাকা থেকে রাতে লঞ্চ ছেড়ে যায়। সকালে নড়িয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে, দুপুরে নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর থেকে নড়িয়ার উদ্দেশে লঞ্চ ছাড়ে।
ঢাকা-নড়িয়া, নড়িয়া-নারায়ণগঞ্জে লঞ্চে ভাড়া নেওয়া হয় ২৫০ টাকা আর নড়িয়া-চাঁদপুরের ভাড়া ১৪০ টাকা। ঢাকা-গোসাইরহাট-ডামুড্যার ভাড়া ৩০০ টাকা। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে বাস শরীয়তপুর জেলা শহরে চলাচল করে। ওই পথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২৭৭ টাকা। ঈদের কারণে শুক্রবার থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৪০০–৬০০ টাকা পর্যন্ত। বাসে বাড়তি ভাড়ার চাপে অনেকে বেছে নিচ্ছেন নৌপথ।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার সদরঘাট থেকে দুটি, নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি ও চাঁদপুর থেকে একটি লঞ্চ যাত্রী নিয়ে এসেছে। ওই লঞ্চে আসা যাত্রীরা পদ্মাপারের আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা। জীবিকার তাগিদে তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে ফিরেছেন।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় থাকেন নড়িয়ার নলতা এলাকার দিদারুল ইসলাম। মঙ্গলবার তিনি নড়িয়া-৪ লঞ্চে করে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন। দিদারুল বলেন, ‘জন্মের পর থেকে লঞ্চযোগেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করছি। পদ্মা সেতু হয়েছে, এখন বাসেও গ্রামে যাওয়া যায়। কিন্তু সহজ ও আরামদায়ক ভ্রমণ হয় লঞ্চে। আমরা চাই, এ নৌপথে যেন লঞ্চ চলাচল অব্যাহত থাকে।’
নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ লঞ্চঘাটের ইজারাদার নুরুল হক ঢালী ওরফে দীপু জানালেন, ঈদে যাত্রীর চাপ বাড়ায় কয়েকটি লঞ্চ বাড়ানো হয়েছে। পদ্মা নদীর তীরের গ্রামের মানুষেরা লঞ্চে যাতায়াত করছেন। ঈদের পর কয়েক দিন কর্মস্থলে ফেরার চাপ থাকবে। প্রয়োজন হলে তখনো লঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো হবে।
তবে পদ্মা সেতু হওয়ার পর লঞ্চের ব্যবসায় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বলে জানালেন নড়িয়া-৪ লঞ্চের মালিক জাহাঙ্গীর লস্কর। প্রথম আলোকে তিনি লেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর শরীয়তপুরের সঙ্গে ঢাকার যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে। আমাদের পুরোনো লঞ্চের ব্যবসাটা বন্ধ হওয়ার পথে। আমাদের চারটি লঞ্চ। এলাকার যাত্রীদের কথা ভেবে দুটি লঞ্চ লোকসানের মুখে চালু রেখেছি। পদ্মাপারের মানুষ নৌপথে লঞ্চে চালাচল করতে নিরাপদ ও স্বস্তি বোধ করেন। এটা ভেবেই নৌপথটিতে লঞ্চ চলাচল টিকিয়ে রেখেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীরা যাতে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন, তার নজরদারি করা হচ্ছে। লঞ্চগুলোতে নিরাপত্তা দেওয়ার যে সামগ্রী থাকে, তা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘাটে পন্টুন ও যাত্রীছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে।