‘গরিবের জন্য ভালো হাসপাতাল নেই। ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। যদি থাকত, তাহলে আমার ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মারা যেত না। ফেনী, চট্টগ্রাম ও ঢাকার এতগুলো হাসপাতালে নেওয়া হলো—কোথাও তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো না। আইসিইউতে সিট পেল না। এখন আমরা কীভাবে চলব?’
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে এভাবেই আফসোস করছিলেন ৮০ বছর বয়সী মুন্সি মিয়া। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ছেলে মো. শাহীনকে (৩৮) বাঁচাতে ফেনী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়েছিলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে ভর্তি করতে পারেননি। আইসিইউ শয্যা না পেয়ে অবশেষে বিনা চিকিৎসায় মারা যান শাহীন।
শাহীনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ঘরের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বারবার বলছিলেন, তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুর ও ছোট তিন ছেলেকে নিয়ে এখন কোথায় যাবেন? কীভাবে চলবেন?
শাহীনদের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার মোটবি ইউনিয়নে। ২৩ এপ্রিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরদিন সকালে ফেনী শহরের অদূরে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পান তিনি। গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তাঁর মাথার একাংশ থেঁতলে যায়।
শাহীনের বাবা মুন্সি মিয়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শাহীনের তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ইয়াছিন আরাফাতের বয়স ১৮। আর মেজ ছেলে শাহরিয়ারের ১৪ এবং ছোট ছেলে আবদুল্লাহর বয়স মাত্র তিন বছর। নিজেদের কোনো জমিজমাও নেই। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে হতদরিদ্র পরিবারটিতে অন্ধকার নেমে এসেছে।
ছেলের অকালমৃত্যুতে মুন্সি মিয়ার চোখের পানি সব শুকিয়ে গেছে। ছোট তিন নাতি, পুত্রবধূসহ এখন পাঁচজনের সংসার কীভাবে চলবে, সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। মুন্সি মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর নিজের কোনো জমিজমা নেই। পৈতৃক ১০ শতক জমি নিয়ে প্রায় ৫০ বছর ধরে আদালতে মামলা চলমান। জমিটি তাঁদের দখলেও নেই। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যানের পুরোনো একটি টিনের ঘরে তাঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। গায়ে শক্তি থাকতে নিজে কাজ করতেন। এখন আর পারেন না। শাহীন এলাকায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। অভাবের কারণে নাতিদের তেমন লেখাপড়াও করাতে পারেননি।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ বলেন, শাহীনদের কোনো জমিজমা নেই। তাঁর (চেয়ারম্যান) পুরোনো একটি টিনের ঘরে তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। শাহীন ভালো মানুষ ছিলেন। গ্রামের লোকের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন।
শাহীনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ঘরের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বারবার বলছিলেন, তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুর ও ছোট তিন ছেলেকে নিয়ে এখন কোথায় যাবেন? কীভাবে চলবেন?
দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর ফেনী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়—চার দিনে জীবন-মরণ লড়াইয়ে শাহীনের সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেশী ও বন্ধু শফিউল আজম (দীপু)। তিনি বলেন, শাহীন গত রোববার ফেনী থেকে বাড়ি ফেরার পথে ফেনী-লস্করহাট সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে আইসিইউতে রাখার পরামর্শ দেন। তবে হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা না থাকায় তাঁকে অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন তাঁরা। পরে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। দুদিন পর আবার ফেনী, পরে ঢাকায় নেওয়া হয়।
শফিউল আজম আরও বলেন, ঢাকায় নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে নেওয়া হলেও সেখানে আইসিইউর শয্যা খালি ছিল না। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়েও শয্যা পাওয়া যায়নি। এরপর রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে মঙ্গলবার মধ্যরাতে তাঁরা ফেনীর উদ্দেশে রওনা হন। ওই দিন ভোর পাঁচটার দিকে ফেনী সদর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। সেখান থেকে জানানো হয়, হাসপাতালে আইসিইউ থাকলেও ভেন্টিলেটর নেই। পরে বাড়িতে নেওয়ার পর বুধবার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।