সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যা মামলার রায় কার্যকর চান স্বজনেরা

পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানফাইল ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর চান স্বজনেরা। সিনহার ৬৬ বছর বয়সী মা নাসিমা আক্তার গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেকে ফিরে পাব না। হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেখে যাতে মরতে পারি।’

দেশব্যাপী আলোচিত সিনহা হত্যার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার। আড়াই বছর আগে বিচারিক আদালতে এ মামলার রায় হয়। এখন আইনি প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ হাইকোর্টে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে এটি।

আদালত সূত্র জানায়, বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার যাবতীয় নথি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছায়, যা একটি ক্রমিকে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে সংশ্লিষ্ট শাখায় নথিভুক্ত হয়। আইন অনুসারে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে।

এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে প্রস্তুত করতে হয় পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত)। এরপর এটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের তালিকায় আসবে। সিনহা খুনের এ মামলায় পেপারবুক প্রস্তুতের কাজ চলছে জানা গেছে।

মামলার আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টে আপিল শুনানির জন্য এখনো তালিকায় আসেনি। পেপারবুকও প্রস্তুত হয়নি। সিনহা হত্যার আগেরও অনেক মামলা এখনো তালিকায় আসেনি, পর্যায়ক্রমে আসবে।

সেদিন যা ঘটেছিল

সিনহা হত্যার ঘটনাক্রম।

৩১ জুলাই ২০২০। বিকেলে মেজর সিনহা নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘জাস্ট গো’র শুটিং করতে সহকর্মী সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) নিয়ে টেকনাফের পাহাড়ে যান। রাত আটটার দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। এরপর নিজের গাড়ি নিয়ে নীলিমা রিসোর্টের দিকে ফিরছিলেন। সাড়ে নয়টার দিকে শামলাপুর এপিবিএনের তল্লাশিচৌকির সামনে তাঁর গাড়ি থামানো হয়। সেখানে একপর্যায়ে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী গুলি করেন সিনহাকে। তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেন।

এরপর সিনহা যেখানে থাকতেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তাঁর ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে পুলিশ। তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে তাঁরা মুক্তি ও মামলা থেকে অব্যাহতি পান। পাঁচ দিন পর ২০২০ সালে ৫ আগস্ট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এতে টেকনাফ থানার তখনকার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের ৯ সদস্যকে আসামি করা হয়। পরে র‍্যাব এ ঘটনায় ওসি প্রদীপ, লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের ১২ জন পুলিশ সদস্য ও ৩ জন গ্রামবাসী (পুলিশের সোর্স)। তদন্ত শেষে একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র‍্যাব।

ওসি প্রদীপ কীভাবে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে টাকার জন্য বন্দুকযুদ্ধ সাজিয়ে খুন করে যাচ্ছিলেন, তা অভিযোগপত্রে উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, তথ্যচিত্র নির্মাণে কক্সবাজারে গিয়ে সিনহা ও তাঁর সঙ্গীরা টেকনাফের নিরীহ মানুষের ওপর ওসি প্রদীপের ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি’ জেনে গিয়েছিলেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে প্রদীপের পরিকল্পনায় সিনহাকে হত্যা করা হয়।

২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ সিনহা হত্যা মামলার রায় দেন। রায়ের আদেশে ১৫ আসামির মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তাঁরা হলেন বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের সাবেক উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কনস্টেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মা, টেকনাফের মারিশবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি (পুলিশের সোর্স) নেজাম উদ্দিন, নুরুল আমিন ও আয়াজ উদ্দিন । প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। বাকি সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন।

আলোচিত এ মামলার আসামিদের সাজা দ্রুত কার্যকর হওয়া উচিত বলে মনে করেন মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিনহা হত্যা অন্য মামলার মতো নয়। হাইকোর্টে পেপারবুক এখনো প্রস্তুত হয়নি। আমাদের সবার চাওয়া, রায়টি দ্রুত কার্যকর হোক। এটি কার্যকর হলে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হব।’