আবদুল্লাহর ছাদবাগানে দেশি-বিদেশি ফলের সহস্রাধিক গাছের সমাহার

নিজের ছাদবাগানে আইনজীবী আবদুল্লাহ হিল বাকী। বৃহস্পতিবার বিকেলে নাটোর শহরের দক্ষিণ বড়গাছা মহল্লায়ছবি: মুক্তার হোসেন

কাপড়ের থলেতে (জিও ব্যাগে) সারি করে রাখা আছে ৫২টি আনার ফলের গাছ। এক থেকে দেড় বছর বয়সী প্রতিটি গাছে ধরে আছে লাল টুকটুকে অসংখ্য আনার। আশপাশে একই ধরনের কাপড়ের থলেতে আছে দেশ-বিদেশি ফলের নানা জাতের সহস্রাধিক গাছ।

ফলদ গাছের এমন সমাহার নাটোর শহরের দক্ষিণ বড়গাছা মহল্লার আইনজীবী আবদুল্লাহ হিল বাকীর চারতলা বাড়িতে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়িটির তিনতলার অর্ধেক ও চারতলার পুরো ছাদজুড়ে গাছগুলো সারিবদ্ধ করে সাজানো। ছাদ ছাড়াও পুরো বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে কৃষির নানা উপকরণে ঠাসা। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও ফলের জাতের বৈচিত্র্য দেখতে প্রায় প্রতিদিন বাগানপ্রেমী লোকজন তাঁর বাড়িতে আসেন।

নাটোর জজকোর্টের আইনজীবী আবদুল্লাহ হিল বাকী বলেন, করোনাকালে আদালতে যাতায়াত কম ছিল। বাড়িতে সময়ও কাটতে চাইত না। হঠাৎ মনে হলো ছাদে বাগান করবেন। নানা ধরনের ফলদ গাছের চারা সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। যোগাযোগ করেন কৃষি কর্মকর্তা ও ছাদকৃষির উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। পরে তাঁর চারতলা বাড়ির তিনতলার অর্ধেক ও চারতলার পুরো ছাদ বাহারি ফলের গাছ দিয়ে সাজিয়ে ফেলেন। তাঁর বাগানে বর্তমানে দেশ-বিদেশের অন্তত ১৬ প্রকার ফলের শতাধিক জাতের সহস্রাধিক গাছ আছে।

সম্প্রতি আবদুল্লাহর ছাদবাগান ঘুরে যান কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর ফিরোজ ও কে জে এম আবদুল আওয়াল (চশমা চোখে)
ছবি: সংগৃহীত

ছাদবাগানে আঙুর, আনার, ড্রাগন, লংগান, মাল্টা, কমলা, জুজুরি, জাবুটিকাবা, পেয়ারা, চুইঝাল, মালবেরি ও তিন ফলের গাছ আছে। এর মধ্যে আঙুর রয়েছে ৯ জাতের। গ্রিনলং আঙুরের উৎপাদন শুরু হয়েছে। সিলভা ও বাইকুনুর জাতের গাছে আঙুর ধরতে শুরু করেছে। ড্রাগন ফল আছে ১২ জাতের। এর মধ্যে রেড ড্রাগন, ইয়োলো ড্রাগন, মাল্টি কালার ড্রাগন, ইকিউটার পালোরা, সুগার, ওমেন্স ডটার, ব্ল্যাক ড্রাগন, ভিয়েতনাম ও পিং রোজ চাষে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। কৃত্রিমভাবে আলোর ব্যবস্থা করে শীতেও ড্রাগন উৎপাদন করছেন।

গত বৃহস্পতিবার পড়ন্ত বিকেলে আবদুল্লাহ হিল বাকীর চারতলা বাড়িতে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দেখা যায়, পুরো বাড়িজুড়ে হরেক রকম গাছগাছালি। তিনতলার ছাদে গিয়ে সিঁড়ি শেষ হয়েছে। সেখান থেকে ভিন্ন সিঁড়িতে চারতলায় গিয়ে দেখা গেল লাল টুকটুকে শত শত পাকা আনার ফল। ছোট ছোট গাছে ১০ থেকে ২০টি করে ফল ঝুলছে। একপলকে একসঙ্গে শত শত আনার দেখে চোখ যেন জুড়িয়ে গেল।

ছাদবাগানের ফলগাছ পরিচর্যা করছেন আবদুল্লাহ হিল বাকী। বৃহস্পতিবার বিকেলে নাটোর শহরের দক্ষিণ বড়গাছা মহল্লায়
ছবি: প্রথম আলো

আবদুল্লাহ গাছ থেকে একটি আনার সংগ্রহ করে কেটে দেখালেন। ফলের মাঝখানটাও রসালো লাল দানায় ভরপুর। মুখে দিয়ে বোঝা গেল আনারগুলো পর্যাপ্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু।
এই ছাদবাগানে আছে ১৮ জাতের আনারগাছ। তবে মৃদুল, অস্ট্রেলিয়ান, রিমন, আফগানি ও সুপার ভাগোয়া জাতের আনার চাষে তিনি ঈর্ষণীয় সফলতা পেয়েছেন। ছাদের ৫২টি জিও ব্যাগে আছে এক থেকে দেড় বছর বয়সী আনার গাছ। প্রতিটি গাছে ফল এসেছে। বেশির ভাগ গাছের ফল পেকে লাল টুকটুকে বর্ণ ধারণ করেছে। বছরে তিনবার ফল পাওয়া যায় এসব আনারগাছ থেকে। গত মৌসুমে এই বাগান থেকে তিনি ২৮০ কেজি আনার উৎপাদন করেছেন। চলতি মৌসুমে আরও বেশি আনার সংগ্রহ করতে পারবেন বলে তাঁর আশা।

আলাপকালে আবদুল্লাহ হিল বাকী জানালেন, তাঁর বাগানে আছে সাত জাতের লংগানগাছ। এর মধ্যে চাইনিজ লংগান, হোয়াইট লংগান, পিং পং, পিঙ্ক পং, থাই, ফোর সিজন, রুবি, কহলা জাতের গাছ আছে। কিছু লংগানগাছে জানুয়ারিতেই কুঁড়ি ধরতে শুরু করেছে। ছাদবাগানে আরও আছে হানিফ ইয়োলো মাল্টা ওয়ান, ইয়োলো মাল্টা টু, এ ফোর ম্যান্ডারিন, ইম্পেরিয়াল, ইম্পেরর, ক্লেমনতিন, পাকিস্তানি কমলা, নেপালি কমলা, বদরুম, ফ্রান্সি মাল্টা, ভ্যালেন্সিয়া, কালাব্রিস, নেভাল বালাদি, জাপানি সিডলেস, টেনজেলোসহ আর কিছু প্রজাতির মাল্টা। ফিলিপাইনের ব্ল্যাক আখ, তুর্কি জাতের উচ্চ ফলনশীল মালবাগীগাছও নজর কাড়ছে।

ছাদবাগানে স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আবদুল্লাহ হিল বাকী
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি আবদুল্লাহর ছাদবাগান ঘুরে দেখেছেন নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর ফিরোজ। তাঁর ভাষ্য, বাগানটি চমৎকার হয়েছে। বাগানটিতে কিছু ফলের অনেক দুর্লভ জাতের গাছ রয়েছে। বিশেষ করে আনার ফলের। দেশের জমিতে আনার চাষ ততটা সফলতা পাননি। কিন্তু এই বাগানের গাছগুলোতে প্রচুর ফল এসেছে। ফলগুলো পরিপক্ব হয়েছে। ফলে যথেষ্ট মিষ্টতা ও রস আছে। আর্থিকভাবেও বাগানমালিক সফল হবেন।

বাগানে দাঁড়িয়ে কৃষি উদ্যোক্তা আবদুল্লাহ হিল বাকী বললেন, আদালতের বাইরের পুরো সময় তাঁর বাগান পরিচর্যায় কাটে। বাগানে ‘ডিপ ইরিগেশন’ পদ্ধতি চালু করেছেন। এই পদ্ধতিতে তিনি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সেচ নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকলেও পানির অভাবে গাছ মারা যায় না। জিও ব্যাগ ব্যবহার করায় ব্যাগে পানি জমে থাকতে পারে না। গাছের শিকড় বিস্তার সহজ হয়। বাতাসে ব্যাগ পড়ে গেলেও ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকে না। নেট দিয়ে ও লাইট জ্বালিয়ে তিনি বাগানের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন। গাছ লাগানোর আগে তিনি ৪০ ভাগ মাটি, ৩০ ভাগ জৈব ও ৩০ ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করেন।

বাবার ছাদবাগানে লাল টুকটুকে ফলের সঙ্গে মেয়ে
ছবি: সংগৃহীত

ছাদবাগানটি ঘুরে দেখে গেছেন ঢাকায় কর্মরত বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের (ডিএই) পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কে জে এম আবদুল আওয়াল। তিনি বলেন, একজন আইনজীবী ব্যস্ততার মধ্যেও এত সুন্দর ছাদবাগান করেছেন, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তিনি ছাদকৃষির আধুনিক ধ্যানধারণা কাজে লাগিয়েছেন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন। আশানুরূপ সাফল্যও পেয়েছেন। তবে এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে তাঁকে বাগানে আরও সময় দিতে হবে।