শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মহাসড়কে সমাবেশ করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা

দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দ। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের মহাসড়কে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাজ’-এর ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে প্রায় ২০০ শিক্ষক অংশ নেন।

দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে থেকে মাথায় ও মুখে লাল কাপড় বেঁধে শিক্ষকেরা র‌্যালি বের করেন। র‍্যালিটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে যেতে শুরু করে। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে প্রধান ফটকের সামনে আগে থেকেই বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকও তালাবন্ধ ছিল। শিক্ষকেরা তালা খোলার অনুরোধ করলে পুলিশ তালা খুলতে বারণ করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিযুক্ত নিরাপত্তাকর্মী তালা খুলে দিলে শিক্ষকেরা প্রধান ফটকের সামনে লাইন ধরে সমাবেশে মিলিত হতে থাকেন। এ সময় পুলিশের কর্মকর্তারা দ্রুত কর্মসূচি শেষ করার অনুরোধ করেন।

সমাবেশে শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য দেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, অধ্যাপক রায়হানা শামস ইসলাম, প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ফারুকী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ফরিদুল ইসলাম প্রমুখ।

দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন। মঙ্গলবার দুপুরে ক্যাম্পাসে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘আমরা ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একাত্মতা ঘোষণা করছি। তাঁদের দাবি ন্যায়সংগত, ন্যায়বিচারের পক্ষে। শিক্ষকসমাজের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের পাশে থাকা। শত শত জীবন ঝরে গেছে, আমরা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এই জীবন ঝরার তালিকায় ছয় বছরের শিশু থেকে সবাই আছে। যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষত কোনো দিনই সারানোর নয়। এই দুঃখবোধ সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। শিক্ষকেরা আজ দলে দলে এসেছেন। এটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। দলমত-নির্বিশেষে সমস্ত নিপীড়নের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখেন।’

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘কবি শামসুর রাহমান নূর হোসেনকে নিয়ে লিখেছিলেন “নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়”। শিক্ষার্থী তোমরা যারা রাজপথে লড়ছ, তোমরা বাংলাদেশের হৃদয় না, তোমরা গোটা বাংলাদেশ। তোমাদের বুকে যে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে, তা সমস্ত বাংলাদেশের বুকে গুলি চালানো হয়েছে। সেই গুলি কোনো পরাশক্তি চালায়নি, চালিয়েছে এ দেশের তথাকথিত এক গণতান্ত্রিক শক্তি। প্রধানমন্ত্রী আপনিও দুই সন্তানের মা। আপনার সরকার প্রকাশ্য দিবালোকে কীভাবে নিরস্ত্র শিশু, ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালাল? আপনি রাতে কীভাবে ঘুমান, আমার খুব বিস্ময় লাগে। আজকে মানুষের ভোটাধিকার নেই। অধিকার নিয়ে দাঁড়ালেই গুলি করে মারা হচ্ছে। রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটি দেশ এভাবে চলতে পারে না।’

র‍্যালিটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে যেতে শুরু করে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা বক্তব্য দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আজকে আমার সন্তান কীসের জন্য প্রাণ দিল? তাঁদের দাবিটা কি খুব অন্যায্য ছিল? প্রধানমন্ত্রী কি তাঁদের এই দাবি মানতে পারতেন না? উনার কোথায় সমস্যা? উনারও তো সন্তান আছে। আমিও দুই সন্তানের মা। আজ মা হিসেবে আমি কথা বলতে পারছি না। আমি শুধু সেই মায়েদের কথাই ভাবছি, যাঁদের সন্তানেরা তাজা রক্ত দিয়ে বলে গেল, আমাদের যৌক্তিক দাবি আমরা আদায় করেই ছাড়ব।’

মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের এই পরিস্থিতিকে বিশ্বের একটি দেশের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। আমরা কোনো পশ্চিম তীরে, কোনো গাজায়, রাফায় অবস্থান করছি। যেখানে মুখ না খুললেও গুলি করা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষকসমাজ বসে থাকতে পারে না। ছাত্রজনতাসহ যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সরকার মুখে বলছে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রাত দুটার দিকে দরজায় নক করে খোঁজা হচ্ছে, ছাত্র আছে কি না। ধরে নিয়ে ডিবি অফিসে নিয়ে যাচ্ছেন। নাটক সাজাচ্ছেন, ভাতের টেবিলে বসাচ্ছেন। এই দ্বিচারিতা মানুষ দেখতে চায় না। জনগণের পালস বোঝেন, জনগণের মনের অবস্থা বোঝেন। শিক্ষক সমাজ কতটা অসহায় হলে রাস্তায় নেমে আসেন। কোনো লাঞ্চের টেবিলে এর সমাধান নেই। চোখে আঙুল দিয়ে এই ছাত্রসমাজ দেখিয়েছে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে।’

শিক্ষকেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটকের বাইরে এসে সমাবেশ করেন। প্রধান ফটকের সামনে আগে থেকেই বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য উপস্থিত ছিলেন
ছবি: শহীদুল ইসলাম

অধ্যাপক ফরিদুল আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকসমাজ গতকাল পেনশন নিয়ে একটি মিটিং করেছে। আমি লজ্জিত শিক্ষক হিসেবে। এই অবস্থায় শিক্ষকদের পেনশন নিয়ে বসা উচিত হয়নি। অনেক সময় আছে। আপনার পেনশন মেনে নিতে বাধ্য। এখন আর কেউ বলবে না যে ওরা আন্দোলন করছে, করুক, ক্লান্ত হয়ে গেলে ফিরে যাবে। এই কথা বলার সাহস আর কারও নেই।’