কয়রায় শিশুর মৃত্যু: পুলিশ বলছে ‘আত্মহত্যা’, মায়ের দাবি ‘পরিকল্পিত খুন’
খুলনার কয়রা উপজেলায় সুন্দরবনের গোলপাতা আহরণের বড় নৌকার মধ্যে ১২ বছরের এক শিশুর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ বলছে, শিশুটি বড় ও উঁচু নৌকার মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবে শিশুটির মা বলছেন, তার আত্মহত্যা করার কোনো কারণ নেই। তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে এখন থানা-পুলিশকে প্রভাবিত করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
শিশুটির নাম সালমান সানা (১২)। শিশুটির তাঁর মা শামসুন্নাহারের সঙ্গে কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের মসজিদকুড় গ্রামে নানার বাড়িতে থাকত।
কয়রা থানা-পুলিশের ভাষ্যমতে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে মসজিদকুড় গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদের তীরে বেঁধে রাখা একটি গোলপাতা আহরণের বড় নৌকা থেকে শিশু সালমানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় তার গলায় ও নৌকার পাটাতনের সঙ্গে ওড়না প্যাঁচানো ছিল। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শিশুটি আত্মহত্যা করেছিল।
আজ শুক্রবার সকালে কয়রা উপজেলা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে নিহত শিশু সালমানের মা শামসুন্নাহার দাবি করেন, ‘আমার ছেলেটিকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আমার ১২ বছর বয়সের ছেলের আত্মহত্যার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। শিশু সালমানকে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শামসুন্নাহার বলেন, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে ছেলে সালমানকে সঙ্গে নিয়ে আমি ঘুমিয়েছি। পরদিন ভোরে সালমান উঠে টয়লেটে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বাইরে যায়। এরপর সকাল সাতটা বাজলেও সে আর ঘরে ফিরে না এলে আমরা তাকে খুঁজতে থাকি। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে আমার মা (নিহত সালমানের নানি) নাছিমা খাতুন বাড়ির পাশের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে যায়। সেখানে নদের তীরে বেঁধে রাখা গোলপাতা আহরণের নৌকার ভেতরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমানকে দেখতে পান। আমরা সেখান থেকে ছেলেটির লাশ উদ্ধার করি। আমার ছেলের গলার বাম পাশে তখন পোড়া দাগ ছিল। গলার বাঁধনও ছিল ঢিলা। এত বড় আর উঁচু নৌকায় ওঠা আমার শিশুসন্তানের পক্ষে অসম্ভব। নৌকায় পাশে তার শরীরে টেনে নেওয়ার চিহ্ন থাকায় আমরা নিশ্চিত, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
এর আগে সালমান অন্যের পোষা কবুতর ধরায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে মসজিদকুড় গ্রামে একটি সালিস হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান তার মা শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, সালিসের একপর্যায়ে গ্রামের নাহিদ মোড়ল ও তাঁর মা ময়না বেগম, হাফিজুল সানা ও তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ জনসম্মুখে সালমানকে হুমকি দিয়ে বলে, তাকে এই এলাকা ছাড়া করবে এবং সুযোগ পেলে তার জীবনে শেষ করে দেবে। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, তাঁরাই আমার ছেলেকে খুন করেছে।’
ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকিদাতাদের পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে কয়রা থানা-পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করেন শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘ছেলের লাশ উদ্ধারের ঘটনার দিন কয়রা থানা-পুলিশ অপমৃত্যুর বিষয়ে একটি কাগজে আমার বাবা নূর ইসলামের স্বাক্ষর নেয়। বাবা অল্পশিক্ষিত, উনাকে ওই কাগজে কী লেখা আছে, সেটা পড়েও শোনায়নি। আমরা মনে করছি, পুলিশের পক্ষ থেকে আমার ছেলের পরিকল্পিত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি আমার শিশুছেলেকে হত্যার প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু বিচার চাই।’
কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যের পোষা কবুতর চুরির কারণে শিশু সালমানকে তাঁর পরিবারের লোকজন ও গ্রামের মানুষ ভর্ৎসনা করে। এ কারণে সে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছি। লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের সদস্যরা হত্যার কোনো অভিযোগ করেননি। এ কারণে পুলিশই বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা করে। এখন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। এখনো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমরা পাইনি। এটা পেতে কয়েক দিন দেরি হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।’