টেকনাফ সৈকতে ছোট মাছে বড় কারবার

টেকনাফের সৈকতে সমুদ্র থেকে ধরে আনা তাজামাছ। বড়ডেইল সৈকত, বৃহস্পতিবার দুপুরে
ছবি-প্রথম আলো।

সমুদ্রসৈকতের বালুচরে পড়ে আছে বিপুল পরিমাণের তরতাজা মাছ। পোপা, ছিটকিরি, ফাইস্যা, লইট্যা, টুইট্যা, চিংড়ি, অলুয়া—এসব ছোট মাছ তখনো মাটিতে পড়ে লাফাচ্ছিল। খানিকক্ষণ আগে ধরে আনা এসব মাছ স্তূপ করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে ওঠে। শুরু হয়ে যায় কেনাবেচাও। ৮ থেকে ১০ জন ব্যবসায়ী মাছগুলো কিনে নিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। তারপর পিকআপবোঝাই করে মাছগুলো নিয়ে গেলেন কক্সবাজারের দিকে।

তাজা মাছ বেচাবিক্রির এই চিত্র টেকনাফের বড়ডেইল সমুদ্রসৈকতে। কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে যার দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিন দেখা গেল, বড়ডেইল থেকে দক্ষিণে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া পর্যন্ত অন্তত ১০ কিলোমিটার সৈকতের ১০ থেকে ১২টি স্থানে এ রকম তাজা মাছ বিক্রি হচ্ছে।

টেকনাফ সৈকতে সমুদ্র থেকে ধরে আনা হচ্ছে ছোট মাছ। বৃহস্পতিবার দুপুরে
প্রথম আলো।

জেলেদের জালে এখন ধরা পড়ছে মূলত ছোট মাছ। তবে এসব ছোট মাছ ঘিরে লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে সৈকতেই। এ ধরনের ছোট মাছ বিক্রি করে একেকটি জেলে নৌকা পাচ্ছে ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। সমুদ্রের অল্প গভীরে ছোট জাল দিয়ে মাছ শিকার করা এসব নৌকা ‘ডিঙি নৌকা’ নামে পরিচিত। কয়েক দিন ধরে লঘুচাপের কারণে ট্রলার নামতে পারছে না সাগরে। তাই মাছের জোগান দিতে এখন এই ডিঙি নৌকাই ভরসা।

মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, লঘুচাপের প্রভাবে কয়েক দিন ধরে বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। এই কারণে গভীর সাগরে গিয়ে টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার শহরের কয়েক হাজার ট্রলারের সামুদ্রিক মাছ আহরণ বন্ধ আছে। জেলার হাটবাজারেও সামুদ্রিক মাছেরও তীব্র সংকট চলছে। ডিঙি নৌকাগুলো উপকূলের কাছাকাছি, অর্থাৎ এক থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে জাল ফেলে ছোট মাছ ধরে আনছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে মাছ আহরণ।

বড়ডেইল সৈকতে স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালামের একটি নৌকায় ধরা পড়েছে প্রায় পাঁচ মণ ছোট মাছ। মাছের মধ্যে রয়েছে—পোপা, ছিটকিরি, ফাইস্যা, লইট্যা, টুইট্যা, চিংড়ি, অলুয়া ইত্যাদি। প্রতি মণ মাছ পাঁচ হাজার টাকা দরে (প্রতি কেজির দাম ১০০ টাকা) কিনে নিলেন কক্সবাজার শহরের ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন। পাঁচ মণ মাছ বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকা পেলেন নৌকার জেলেরা।

নৌকার মালিক আবুল কালাম (৫০) বলেন, সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটা নৌকা পাঁচ থেকে ছয়বার সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরতে পারে। একটি নৌকাতে জেলেশ্রমিক থাকেন ১২ থেকে ১৫ জন। নৌকা নিয়ে সাগরের এক কিলোমিটার দূরে জাল ফেলা হয়। জালের দুই মাথা থাকে কূলে। জেলেরা বালুচরে দাঁড়িয়ে জাল টেনে আনেন। টানাজাল তুললে পাওয়া যায় ছোট মাছ।

আবদুর রহিম নামের এক জেলে বলেন, মাঝেমধ্যে ছোট মাছের এই জালে দুই থেকে চার কেজি ওজনের বিপুল পরিমাণ লাল কোরাল ধরা পড়ে। তখন জেলেদের কপাল খুলে যায়। প্রতিটি লাল কোরাল বেচাবিক্রি হয় হাজার টাকায়।

মহেশখালীয়াপাড়ার আরেকটি নৌকায় ধরা পড়েছে ১২ মণ ছোট মাছ। বিক্রি করে জেলেরা পেয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। নৌকার মালিক আবদুল গফুর (৪৫) বলেন, সারা দিন মাছ ধরে ৯০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার টাকা পাবে ১৫ জন জেলেশ্রমিক। অবশিষ্ট ৬০ হাজার টাকা পাবেন তিনি। একটি নৌকার বিপরীতে (নৌকা, জাল, ইঞ্জিন) ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। অনেকে দাদন নিয়ে মাছ ধরতে নামেন।

ডিঙি নৌকার আরও কয়েকজন মালিক জানান, সংকট মুহূর্তে হাটবাজারে ছোট মাছের চাহিদা বাড়ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন টেকনাফের সৈকত থেকেই অন্তত ২২০ মণ ছোট মাছ কক্সবাজার, উখিয়া, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়ার বাজারে সরবরাহ হচ্ছে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে মাছ সরবরাহ দেন মরিচ্যাবাজারের ব্যবসায়ী নাজির হোসেন (৫৫)। গতকাল টেকনাফের সৈকত থেকে তিনি ৩০ মণের বেশি ছোট মাছ কিনেছেন। নাজির হোসেন বলেন, অধিকাংশ মাছ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ করবেন তিনি। ৯ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবিরে ছোট মাছের চাহিদা বেশি। সেখানে প্রতি কেজি ছোট মাছ বিক্রি করবেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। আশপাশের মরিচ্যাবাজার, উখিয়া, কুতুপালং, রামু বাজারে একই দামে ছোট মাছ বিক্রি হয়।

টেকনাফের সৈকত থেকে ১০০ টাকায় মাছ কিনে সেই মাছ সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় বেচাবিক্রির কারণ জানতে চাইলে নাজির হোসেন বলেন, অনেক দূর থেকে মাছ কিনে বাজারে পৌঁছাতে গাড়িভাড়া,বরফ ও শ্রমিকখরচ চলে যায় অনেক। ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় মাছ বিক্রি করেও কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকার বেশি লাভ করা যায় না।

দেখা গেছে, মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া থেকে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া পয়েন্ট পর্যন্ত সৈকতে পড়ে আছে পাঁচ শতাধিক রঙিন ডিঙি নৌকা। দিনের বেলায় নৌকাগুলো সমুদ্রে মাছ ধরে। বিকেলে তুলে রাখা হয় বালুচরে। মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকেরা রঙিন নৌকার পাশে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে তোলেন ছবি, কেউ কেউ ধারণ করেন ভিডিও চিত্র।

টেকনাফ ডিঙি নৌকা মালিক সমিতির সভাপতি সুলতান আহমদ বলেন, সমিতির আওতায় প্রায় ২ হাজার নৌকা আছে। এর মধ্যে কয়েক শ নৌকা মাছ ধরছে। সাগরে তেমন মাছও ধরা পড়ছে না। তাতে ১৫ হাজারের বেশি জেলেশ্রমিক অর্থসংকটে দিন কাটাচ্ছেন।