শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নারী চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান খাদিজা খানম সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি এ হামলার ঘটনায় করা মামলার আসামি উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক জুলহাস মাদবরের স্ত্রী। এ মামলায় জুলহাস-খাদিজা দম্পতির ছেলে তামজিদ মাহমুদকেও আসামি করা হয়েছে।
আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খাদিজা খানম উপজেলা পরিষদে তাঁর অফিসকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর স্বামী ও ছেলেকে নির্দোষ দাবি করেন। রাজনৈতিক ইন্ধনে তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেন খাদিজা। এ সংবাদ সম্মেলনের পর বেলা একটার দিকে খাদিজা খানম শতাধিক লোক নিয়ে মানববন্ধন করেন।
গত বুধবার রাতে ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন নুসরাত তারিনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গত শনিবার দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন আহত চিকিৎসক নুসরাত তারিনকে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এরপর এ হামলার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনা তৈরি করে।
ওই ঘটনায় নুসরাতের স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার সকালে ডামুড্যা থানায় মামলা করেন। এতে ডামুড্যার আওয়ামী লীগের নেতা জুলহাস মাদবর, তাঁর ছেলে আব্দুর রাজ্জাক কলেজের স্নাতকের ছাত্র তামজিদ মাহমুদ ও ল্যাবএইড ফার্মা লিমিটেডের বিক্রয় প্রতিনিধি শহীদুল ইসলামের নাম উল্লেখ এবং ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মামলার পর বৃহস্পতিবার দুপুরেই জুলহাস ও শহীদুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জুলহাস ডামুড্যা সদরের বাসিন্দা। শহীদুল শরীয়তপুর সদর উপজেলার মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা। গতকাল রোববার দুপুরে আদালত থেকে জামিন পান জুলহাস। সন্ধ্যায় তিনি কারামুক্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন।
৪২তম বিসিএসের চিকিৎসক নুসরাত তারিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেন।
খাদিজা খানম সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি শহীদুল ও চিকিৎসক নুসরাত পূর্বপরিচিত। কিন্তু জুলহাস তাঁদের পূর্বপরিচিত নন। চিকিৎসক নুসরাত ও তাঁর স্বামী মঞ্জুরুল ইসলামের মধ্যে দাম্পত্য কলহ রয়েছে। এ জন্য তাঁরা দুজনই বিভিন্ন সময় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও তাঁদের পূর্বপরিচিত শহীদুলের সহায়তা নেন। গত বুধবার শহীদুল খাদিজার কাছে এসে জানান, ব্যক্তিগত বিরোধে তাঁকে চিকিৎসক নুসরাতের স্বামী মারধর করেছেন। এ ঘটনাটি দেখার জন্য খাদিজার সহযোগিতা চান শহীদুল। খাদিজা ব্যস্ত থাকায় সন্ধ্যার দিকে তাঁর স্বামী জুলহাসকে ঘটনাটির খোঁজখবর নেওয়ার জন্য সেখানে পাঠান। কিন্তু শহীদুলের সঙ্গে জুলহাসকে দেখে নুসরাতের স্বামী ও তাঁর লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তখন খাদিজার স্বামী জুলহাসকে অপমান-অপদস্থ ও মারধর করা হয়।
খাদিজা বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি বুঝে ওঠার আগেই চিকিৎসকের ওপর হামলা করা হয়েছে দাবি করে তাঁরা বিভিন্ন মহলে জানাতে থাকেন। আমরা চাই ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ প্রকৃত ঘটনা বের করুক। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চিকিৎসককে ব্যবহার করে আমাদের বিপদে ফেলছেন।’
ল্যাবএইড ফার্মার ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার অনুরোধ করতেন তাদের বিক্রয় প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম। আমি বিভিন্ন সময় তা লিখতাম। সব সময় ও বেশি লেখার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। ওই ঘটনার জেরে শহীদুল ও আওয়ামী লীগ নেতা জুলহাসের নেতৃত্বে আমার ওপর হামলা করা হয়।
জামিনে মুক্ত জুলহাস মাদবর দুপুরে ঢাকা থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক দম্পতির সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির ব্যক্তিগত বিরোধের বিষয় জানতে চাওয়ায় তাঁরা আমার ওপর চড়াও হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় করার জন্য আমাকে অপরাধী বানিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় আমি জড়িত নই।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চিকিৎসক নুসরাত তারিন আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ল্যাবএইড ফার্মার ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার অনুরোধ করতেন তাদের বিক্রয় প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম। আমি বিভিন্ন সময় তা লিখতাম। সব সময় ও বেশি লেখার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। ওই ঘটনার জেরে শহীদুল ও আওয়ামী লীগ নেতা জুলহাসের নেতৃত্বে আমার ওপর হামলা করা হয়।’
নুসরাতের স্বামী চিকিৎসক মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপত্রে একটি কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য আমার স্ত্রীকে চাপ দিচ্ছিল শহীদুল। সে আমাকেও চাপ দিতে থাকে। এ নিয়ে কিছুটা বিরোধ হয়। আমি তাকে মারধর করেছি, এমন নয়। বরং সে আওয়ামী লীগ নেতা জুলহাসকে নিয়ে আমার স্ত্রীর ওপর হামলা করেছে।’
পারিবারিক বিষয়ে শহীদুলের সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নুসরাতের স্বামী মঞ্জুরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একত্রে থাকি। আমাদের মধ্যে কোনো ভুল–বোঝাবুঝি নেই। কখনো হলেও আমি তো আর ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিকে ব্যক্তিগত বিষয়ে বলতে যাব না। কোনো অপরাধী অপরাধ আড়াল করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সামনে আনেন। তাই তাঁরাও নতুন গল্প বানাচ্ছেন।’
ডামুড্যা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমারত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় মামলার দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের একজন জামিন পেয়েছেন। কেন এ ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে।
৪২তম বিসিএসের চিকিৎসক নুসরাত তারিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেন। তিনি এই উপজেলারই শিধলকুড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শাহজালাল মিয়ার মেয়ে।
ডামুড্যা থানা-পুলিশ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, চিকিৎসক নুসরাত তারিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালনের পর উপজেলা সদরের বেসরকারি হাজী আলী আজম জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাসেবা দেন। ল্যাবএইড ফার্মা লিমিটেডের বিক্রয় প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম ওই চিকিৎসককে ব্যবস্থাপত্রে তাঁদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য বিভিন্ন সময় চাপ দিতেন। এ ছাড়া পারিবারিক কিছু বিষয় নিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার এলাকায় ওই চিকিৎসকের স্বামী চিকিৎসক মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়ার সঙ্গে শহীদুলের গত মঙ্গলবার কথা–কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরদিন বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নুসরাত তারিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বাসায় ফেরার পথে হাজী আলী আজম জেনারেল হাসপাতালের সামনে তাঁর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন।