বেহাল প্রাথমিক বিদ্যালয়

মামলার কারণে বিদ্যালয়ের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। মাত্র চার কক্ষবিশিষ্ট একটি একতলা ভবনে চলছে পাঠদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম।

ফরিদপুরের সালথার কুমারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে নতুন ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এতে শ্রেণিকক্ষ–সংকটসহ সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাছবি: প্রথম আলো

দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে, তখন ফরিদপুরের কুমারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বেহাল।

মাত্র চার কক্ষবিশিষ্ট একটি একতলা ভবনে চলছে বিদ্যালয়টির পাঠদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম। এর মধ্যে একটি কক্ষ শিক্ষকদের বসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি তিনটিতে চলছে পাঁচটি শ্রেণির শিশুদের পাঠদান। জমি নিয়ে বিরোধের কারণে বিদ্যালয়টিতে এ অবস্থা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকেরা।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নে কুমারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান। দ্রুত সমস্যা সমাধান করে বিদ্যালয়টিকে আধুনিক ও মানসম্পন্ন একটি বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার দাবি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও এলাকাবাসীর।

বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কুমারকান্দা গ্রামের রফিক ফকির বলেন, এ এলাকার এই একটিমাত্র সরকারি বিদ্যালয়। এর দুরবস্থা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। ওখানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ নেই। আরেক অভিভাবক যদুনন্দী খালপাড়া গ্রামের আকতার হোসেন বলেন, এলাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এভাবে মামলা করা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু কে শোনে কার কথা। মামলার কারণে বিদ্যালয়ের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে ৭৬ শতাংশ জমির ওপর গড়ে ওঠে বিদ্যালয়টি। সে সময়ে বিদ্যালয়টির নামে এ জমি দান করেন ওই এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম মাতুব্বর, ইসলাম মিয়া মাতুব্বর ও আতিয়ার মাতুব্বর নামের তিন ভাই। ১৯৯২ সালে নির্মিত হয় চার কক্ষের বর্তমান এই একতলা ভবন। এ ভবনেই চলছে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম। বর্তমানে ২৫০ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন এ বিদ্যালয়ে।

২০১৩ সালে জাতীয়করণ হওয়ার পর ওই বিদ্যালয়ের জমির মালিক দাবি করেন, একই এলাকার সামচু ফকির গং বাদী হয়ে জমিদাতা ও বিদ্যালয়ের নামে মামলা করেন, যা আজও নিষ্পত্তি হয়নি।

বিদ্যালয়ের জমিদাতা তিন ভাইয়ের মধ্যে বর্তমানে নজরুল ইসলাম মাতুব্বর জীবিত আছেন। তিনি বলেন, ‘সেই সময়ে এ এলাকায় কোনো স্কুল না থাকায় আমরা তিন ভাই সবার অনুরোধে ৭৬ শতক জমি দান করি। প্রতিষ্ঠার সময় এ জমি নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। তবে আদালত বিদ্যালয়ের পক্ষে রায় দেন। আদালতের রায় পেয়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০১৩ সালে আবার মামলা করেন সামচু ফকির গং। নিম্ন আদালত, হাইকোর্টসহ তিনটি মামলায় আমাদের পক্ষে রায় হয়। তবে জমির মালিকানা দাবিদার সামচু ফকির গং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন, যা বিচারাধীন।’

ওই জমির মালিকানা দাবি করা অংশীদারদের মধ্যে মো. পান্নু ফকির নামে একজন বলেন, ‘এই জমি আমাদের নামে রেকর্ড ভোগদখল দলিল করা। বর্তমানে আমাদের চাচা ও চাচাতো ভাই-বোন মিলে ২৬ জন ওই জমির অংশীদার। কিন্তু নজরুল ইসলামরা জাল দলিল দেখিয়ে স্কুলের নামে দান করে দেন। এখন মামলা হাইকোর্টে চলছে। হাইকোর্ট যে রায় দেবেন, সেটা আমরা মেনে নেব।’

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে গরু বাঁধা রয়েছে। বিদ্যালয়ের মাঠ খানাখন্দে ভরা, খেলাধুলার অনুপযোগী। মাঠের এক পাশে বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিশিয়ে গোয়ালঘর নির্মাণ করেছেন জমির মালিকানা দাবি করা মৃত সামচু ফকিরের শরিকেরা। ২৫০ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষকের জন্য একটিমাত্র শৌচাগার। ১৯৯২ সালে নির্মিত ভবনটি সংস্কার না করায় বেহাল হয়ে পড়েছে।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হাবিবা বলে, ‘বৃষ্টি হলে ক্লাসরুমে পানি পড়ে। মাঝেমধ্যে পলেস্তারা খসে পড়ে। আমাদের আতঙ্কে থাকতে হয়।’ একই শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. সিয়াম হোসেন বলে, ‘একটিমাত্র টয়লেট থাকায় টয়লেট ব্যবহার করতে সমস্যা হয়।’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে বিরোধ থাকার কারণে ওয়াশ ব্লক নির্মাণ, আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল স্থাপন, একাধিক স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার স্থাপন, শহীদ মিনার, নতুন ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এগুলোর বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজ করা যাচ্ছে না বিরোধিতার কারণে। শেখ রাসেল কর্নার, প্রাক্‌-প্রাথমিকের কক্ষ তৈরি করা যাচ্ছে না। বাগান করা, বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ সরকারের নানা উদ্যোগ ব্যাহত হচ্ছে। আমরা এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে রয়েছি।’

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতিকুর রহমান বলেন, বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানালে তিনি বিদ্যালয়ের সভাপতি, প্রধান শিক্ষক ও জমিদাতার সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু মামলা থাকায় কিছু করা যাচ্ছে না।