গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে চট্টগ্রাম নগরে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নামা ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ধরা পড়েননি। র্যাব-পুলিশ ইতিমধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করলেও কারও কাছ থেকে উদ্ধার করা যায়নি ঘটনায় ব্যবহৃত কোনো অস্ত্র।
পুলিশ বলছে, অস্ত্রধারীদের সবাই যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মী। প্রদর্শিত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে পিস্তল, শটগান ও কাটা বন্দুক। মোট কতজন অবৈধ অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন, তা শনাক্তের কাজ চলছে।
নগরের মুরাদপুরে গত বছরের ১৮ জুলাই গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। তাঁর ভগ্নিপতি দীপক মিস্ত্রি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাদের হাতে অস্ত্র ছিল, পুরো দেশবাসী বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
চট্টগ্রামে গত বছরের ১৬ ও ১৮ জুলাই এবং ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলি ও হামলায় নগরে ১০ জন নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক মানুষ। এসব ঘটনায় ৮২টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, ফজলে করিম চৌধুরী, আবু রেজা নদভীকে।
এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবিতে দেখা যায়, নগরের মুরাদপুর এলাকায় (১৬ জুলাই) পিস্তল হাতে ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপ–অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কাটা বন্দুক হাতে ছিলেন যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মো. ফিরোজ। তিনি নিজেকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী পরিচয় দেন। তবে কোনো পদে নেই। শটগান হাতে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সংগঠক মো. দেলোয়ারকে দেখা যায়। তিনি হেলাল আকবরের অনুসারী। পিস্তল হাতে দেখা যায় যুবলীগ কর্মী এন এইচ মিঠু ও মো. জাফরকে। তাঁরা দুজন নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নুরুল আজিম রনি শিক্ষামন্ত্রীর অনুসারী। অস্ত্রধারীদের মধ্যে শুধু ফিরোজকে গত ২৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে র্যাব। অন্যরা এখনো ধরা পড়েননি।
নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট এলাকায় ১৮ জুলাই পিস্তল হাতে দেখা যায় চান্দগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন ফরহাদ, যুবলীগ কর্মী মো. জালাল ওরফে ড্রিল জালাল ও মো. মিজানকে। শটগান হাতে ছিলেন যুবলীগ কর্মী মো. তৌহিদ। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন, অস্ত্রধারীরা সবাই নগরের ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর মো. এসরালের অনুসারী। এর মধ্যে র্যাব ১৭ সেপ্টেম্বর মিজানকে, ২৩ নভেম্বর তৌহিদুলকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদের হদিস মেলেনি।
এদিকে গত ৪ আগস্ট নগরের নিউমার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগের সংঘর্ষে প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্রের বেশি ব্যবহার হয়েছে। সেদিন নগরের কোতোয়ালি থানার নিউমার্কেট ও আসকার দিঘির পাড় এলাকায় ১০ জন অস্ত্রধারীকে দেখা গেছে। পুলিশ থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিটি কলেজ রোডের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের পেছন থেকে রিভলবার হাতে গুলি ছোড়েন হেলমেট পরা এক যুবক। তাঁর পাশে থাকা আরেকজনকে ককটেল নিক্ষেপ করেন। স্থানীয় লোকজন জানান, রিভলবার হাতে দেখা যাওয়া ওই যুবক সিটি কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা। একই সময়ে নগরের নিউমার্কেট এলাকায় মাথায় হেলমেট ও শটগান হাতে এক যুবক এবং পিস্তল হাতে কালো টি-শার্ট পরা আরেক যুবককে দেখা যায় গুলি ছুড়তে। দুপুর ১২টার দিকে একই জায়গায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায় পিস্তল হাতে থাকা আরও এক যুবককে।
গত ৪ আগস্ট নগরের জামাল খান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে বেলা ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে নগরের আসকার দিঘির পাড় এলাকায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিতে দেখা গেছে। ওই সময় তাঁর পাশে থাকা এক যুবককে শটগান হাতে দেখা যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, কাউন্সিলর ওই যুবককে সামনে এগোতে নির্দেশ দিচ্ছেন। এরপর বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ার শব্দ শোনা যায়। ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে জামালখান ও সার্সন রোডের দিকে চলে যান। শটগান হাতে থাকা যুবকের নাম ফরহাদুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে রিন্টু। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপসমাজসেবা সম্পাদক। একই সময়ে তাঁদের সঙ্গে থাকা আরেকজনকে অস্ত্র কোমরে গুঁজতে দেখা যায়। তবে তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. রইছ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কাছে চারজনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ইতিমধ্যে ১০ জন অস্ত্র প্রদর্শনকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। তবে কতজন অস্ত্রধারী ছিলেন, তা নির্দিষ্ট করে শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনাস্থলের ভিডিও, ছবি দেখে অস্ত্রধারীদের শনাক্তের কাজ চলছে।
প্রকাশ্য অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার ও খুনের ঘটনায় ব্যবহার করা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।