‘আন্দোলন আমার বুকের ধন কেড়ে নিল’
‘১৮ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে ঢাকার মিরপুরে ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় সে (শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন)। ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে তার মস্তিষ্ক ছেদ হয়ে যায়। তখন আমি গ্রামের বাড়িতে। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছাতে রাত প্রায় একটা বেজে যায়। পথে পথে অনেক বাধা পেরিয়ে ছেলের কাছে গেলেও তাকে জীবিত ফেরাতে পারিনি।’ একটানা কথাগুলো বলেই শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করেন শাহরিয়ারের বাবা মোহাম্মদ আবদুল মতিন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে শাহরিয়ারের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শাহরিয়ারের বাবাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছেন কয়েকজন বন্ধু। সেখানে বাড়ির আঙিনায় কথা হয় আবদুল মতিনের সঙ্গে।
আবদুল মতিন বলেন, ‘লাইফ সাপোর্টে থাকা ছেলেকে গত শনিবার বেলা দুইটার দিকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে শাহবাগ থানায় জিডি করি। ময়নাতদন্ত শেষে রোববার রাত সাড়ে ১২টায় বাড়িতে আনা হয় মরদেহ। সোমবার সকাল ১০টায় জানাজা শেষে দাফন করা হয় বাড়ির সামনের গোরস্থানে।’ একটু থেমে মতিন আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ছোট একটা গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল! ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে বিচার চাইব?’
বাবার চাকরির সুবাদে অনেক সময় ঢাকাতেও থাকতেন শাহরিয়ার। রাজধানীর কুড়িল কুড়াতলী বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে তাঁর পরিবার। ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার আইডিয়াল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হলেও বাকি পরীক্ষাগুলোয় তিনি আর উপস্থিত হতে পারবেন না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় ১০ জুলাই ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন তিনি।
চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হলেও বাকি পরীক্ষাগুলোয় তিনি আর উপস্থিত হতে পারবেন না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় ১০ জুলাই ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ারের বাবা বলেন, ‘পরীক্ষার মধ্যে বন্ধ পেয়ে ঢাকায় মায়ের কাছে যায় ছেলে। পরে মিরপুর ২ নম্বরে খালার বাসায় বেড়াতে যায়। সেখানে খালাতো ভাই বাদলের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেয়। পরে মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় শাহরিয়ার। বাদলও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। সেদিন একপাশে ছিল আন্দোলনকারী; অপর পাশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ।’
শাহরিয়ারের মা মমতাজ বেগম কোনো সান্ত্বনাই মানছেন না। একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছেন তিনি। তবু তাঁর কান্না থামছিল না; বারবার একই কথা বলছিলেন, ‘আন্দোলন আমার বুকের ধন কেড়ে নিল।’
শাহরিয়ারের বাবা আবদুল মতিন আহাজারি করে বলেন, ছেলে হারানোর শোক সইতে পারছেন না। মনের পর্দায় বারবার ভেসে ওঠে ছেলের মুখ, তাঁর স্মৃতি। সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমাকে চাকরি করে অনেক কষ্টে জীবন চালাতে হতো। এসব দেখে ছেলে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলে আন্দোলনে যাবে, এটি জানলে কখনোই তাকে ছাড়তাম না। ঢাকায় যাওয়ার সময়ও অনেক নিষেধ করেছিল তার চাচা, যেন কোনো আন্দোলনে অংশ না নেয়।’
এ ঘটনায় কোনো ধরনের প্রশাসনিক, পুলিশি কিংবা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হতে চায় না শাহরিয়ারের পরিবার। এ প্রসঙ্গে তাঁর চাচা আবদুল মোতালিব বলেন, ‘আমার ভাতিজাকে হারিয়েছি। প্রশাসন নানা তথ্য নিচ্ছে। আমরা কোনো ধরনের প্রশাসনিক, পুলিশি কিংবা রাজনৈতিক হয়রানি চাই না। বিচার একদিন পাব, এ আশায় বাকি জীবন কাটাব।’