আছে শুধু দুঃসহ স্মৃতি
বরিশালের চৌমাথা ধরে নবগ্রাম হয়ে বানারীপাড়ায় যেতে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। খালের পাড় ধরে যেতে অগ্রহায়ণের কম আয়ুর দিনের সূর্য মাথার ওপর। এখনো এই গ্রামের দুপুরের নীরবতা ভাঙে পাখির কলরবে। ১৯৭১ সালে এই গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলির শব্দে। ঝাঁঝরা হয়েছিল শত নিরীহ মানুষের বুক। তাঁদের রক্তে ভিজে গিয়েছিল শান্ত এই গ্রামের ধুলামাটি। খালের স্বচ্ছ জলে রক্তের ধারা মিশে হয়েছিল লালে লাল।
গাঢ় সবুজের সান্নিধ্যে থাকা এই শান্ত গ্রামের নাম দক্ষিণ নরেরকাঠি। ১৯৭১ সালের ২ মে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা বীভৎস হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই দিন এই গ্রামের দেড় শ নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন সরকারবাড়ির পুকুরপাড়ে ২৮ জনের লাশ গণকবর দেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন উৎসর্গ করা এসব শহীদের স্মৃতি রক্ষায় সরকারি উদ্যোগে এ বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
এই বীভৎস গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী দক্ষিণ নরেরকাঠি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ১৯৭১ সালের ২ মে দুপুর। সূর্য তখন মাথার ওপর। কেউ দুপুরের আহার সেরেছেন, কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এই গ্রামে আসে। রাজাকার সদস্যরা শান্তি কমিটি গঠন এবং শান্তি কমিটির উদ্দেশ্য অবগত করতে গ্রামের লোকজনকে বাড়ি থেকে ডেকে আনে দক্ষিণ নরেরকাঠি এলাকার খালপাড়ে। তাঁদের লাইনে দাঁড় করানো হয়। এরপর শুরু হলো নির্বিচার গুলি। নিরীহ মানুষের আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে শান্ত গ্রামটি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় হানাদার বাহিনী। খালের পাড়ে পড়ে থাকে সারি সারি লাশ। এভাবেই হত্যা করা হয় প্রায় দেড় শ নারী–পুরুষকে। এটাই ছিল বরিশাল অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর নৃসংশ গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ওই দিন পশ্চিম নরেরকাঠি গ্রামের মঞ্জু রানী হাওলাদারের স্বামী ও স্বজনদের হত্যা করা হয়। স্বজন হারানোর বেদনা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। মঞ্জু রানীর বয়স ৭০ পেরিয়েছে। কাঠ, বাঁশ আর ভাঙাচোরা টিনের ছাউনির ঘরে একা বাস করেন তিনি।
গত মঙ্গলবার দুপুরে মঞ্জুর রানীর বাড়িতে গিয়ে শোনা গেল তাঁর বায়ান্ন বছর ধরে বয়ে বেড়ানো দুঃসহ জীবনের কথা। সেদিনের কথা তুললেই কাঁদতে শুরু করেন মঞ্জু রানী। মুক্তিযুদ্ধের তিন বছর আগে এই গ্রামের মনোরঞ্জন হাওলাদারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বিয়ের বছর দেড়েক যেতেই তাঁর কোলজুড়ে আসে তাঁদের একমাত্র সন্তান অরুণা রানী।
আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মঞ্জু রানী সেই দিনের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে বলেন, ১৯৭১ সালের ২ মে বেলা দুইটার দিকে হানাদার বাহিনী বরিশাল ও বানারীপাড়া—দুই দিক থেকে হেঁটে দক্ষিণ নরেরকাঠি গ্রামে প্রবেশ করার খবর পাওয়ার পর মঞ্জু রানী ও মেয়ে অরুণাকে তাঁর স্বামী পাশের গ্রামে ঘোষ বাড়ির এক বন্ধুর পরিবারের কাছে রেখে বাড়িতে আসেন। মঞ্জু রানী সন্তানকে নিয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে বাড়ির পেছনেই একটি মাঠ খুঁড়ে তৈরি করা বাংকারে আশ্রয় নেন। মনোরঞ্জন বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা উপেন্দ্র হাওলাদারকে নিরাপদে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখেন, দুজন রাজাকার হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে তাঁদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। মনোরঞ্জন ও তাঁর বাবা উপেন্দ্রকে ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে নেওয়া হয় দক্ষিণ নরেরকাঠি গ্রামের খালপাড়ে। সেখানেই বাবা-ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। তাঁদের লাশও আর খুঁজে পাননি মঞ্জু রানী।
প্রত্যক্ষদর্শী গাভা হাইস্কুরের প্রধান শিক্ষক বেণী লাল দাশগুপ্ত বলেন, ‘ঘটনার সময় খালের পাড়ে ধানখেতে লুকিয়ে এ নির্মম গণহত্যার দৃশ্য দেখছিলাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গাভায় এসে স্থানীয় আক্কাস আলী খান ও শরৎ সমদ্দারকে দিয়ে গ্রামের মানুষকে নরেরকাঠি খালপাড়ে নিয়ে আসে। আমি তখন খালের ওপারে ধানখেতের মধ্যে থেকে সেনাদের তৎপরতা দেখছিলাম। খালপাড়ে তরুণ ও যুবকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে শুরু হলো ব্রাশফায়ার। অধিকাংশ মানুষ খালে পড়ে গেল। খালের পানি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মৃত মানুষ ভেসে যেতে লাগল।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ নরেরকাঠির এই বধ্যভূমি দীর্ঘদিন অরক্ষিত ছিল। নরেরকাঠি খালের পশ্চিম পাড়ের এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে প্রথমে ২০১০ সালে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক সুখ রঞ্জন বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করেন এবং এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান। পরে এই স্থানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি প্রকল্পের আওতায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ২০১৯ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের বরিশাল কার্যালয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১১ শতক জমির ওপর প্রায় ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।