আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা, নিখোঁজ ১৮২ ব্যক্তির তালিকা যাচাইয়ে পুলিশকে চিঠি

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গাজী অটো টায়ার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। গত ২৬ আগস্ট দুপুরে তোলাছবি: দিনার মাহমুদ

লুটপাটের সময় হেলমেট পরা কয়েকজন দুর্বৃত্ত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গাজী অটো টায়ার কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এ দুর্ঘটনার পর ভিন্ন ভিন্ন তালিকা থেকে নিখোঁজ মোট ১৮২ ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা যাচাইয়ে গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, তদন্ত কমিটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা যাচাইয়ের জন্য পুলিশ সুপারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভবনটি বুয়েটের প্রকৌশলীরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছেন। ভবনটিতে কীভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, অচিরেই কারখানার মালিকের সহায়তায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করা হবে।

রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় ২৬ একর ৭২ শতাংশ জমির ওপর গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি হত্যা মামলায় কারাগারে। ওই কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটের ঘটনায় ১২ অক্টোবর জেলা প্রশাসনের গঠিত ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান ৩২ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর আগে অগ্নিকাণ্ডের দুই দিন পর গত ২৭ আগস্ট হামিদুরকে আহ্বায়ক করে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

রূপগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানার সামনে মানুষের ভিড়। গত ২৬ আগস্ট দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাজী টায়ারে আগুন দেওয়া হয়। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যাঁদের জমি দখলে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেলা ৩টায় রূপসী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একত্র হতে খাদুন এলাকার খাঁ পাড়া জামে মসজিদ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে একত্র হওয়া জনতার একটি অংশ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কারখানায় ঢুকে লুটপাট শুরু করে। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে লুটপাটকে কেন্দ্র করে কারখানার নিচতলায় লুটপাটকারী একাধিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। খাঁ পাড়া মসজিদ থেকে গাজী টায়ারে ডাকাত ঢুকেছে বলে তাদের প্রতিহত করতে এলাকাবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়। পরে লুটপাটকারীরা ভবনের চার ও পাঁচতলার তামা ও দামি কেমিক্যাল নিতে ওপরে উঠতে থাকে।

এর মধ্যে একদল লুটকারী ওপরে উঠলে আরেক দল লুটকারী ভবনের নিচতলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেটের শাটারে তালা ঝুলিয়ে চলে যায়। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস দল পৌঁছানোর পর ভবনের পশ্চিম পাশের সিঁড়িতে টর্চ ফেললে ভেতর থেকে আনুমানিক ১২ জন পালিয়ে যান। ভবন থেকে কোনো মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। ১ সেপ্টেম্বর ভবনের ভেতর থেকে দেহের বিভিন্ন অংশের ১৫ খণ্ড হাড় পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটির গণশুনানিতে নিখোঁজ ৮০ ব্যক্তির পরিবার তথ্য দেয়। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষার্থী কর্তৃক ভিন্ন ভিন্ন তালিকা তৈরি করা হয়। এসব তালিকা থেকে নিখোঁজ ১৮২ ব্যক্তির তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য যাচাই–বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন।

রূপগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানার পুড়ে যাওয়া মেশিনারিজ। গত ২৬ আগস্ট দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন ও কারখানা কর্তৃপক্ষের লিখিত বক্তব্য থেকে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্টের আগে গাজী টায়ার কারখানায় ৫ আগস্ট লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে পাহারার দায়িত্ব দেন। কয়েক দিন পর পাহারার দায়িত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ হয়। একটি পক্ষ পাহারা দিতে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে, কারখানা কর্তৃপক্ষ রাজি না হলে তারা হুমকি দিয়ে ২৫ আগস্ট কারখানা ছাড়ে।

উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য ফায়ার সার্ভিস, নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগসহ অন্যরা মতামত চাইলে বুয়েটের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক রাকিব আহসানসহ অন্যরা ফায়ার সার্ভিসের টিটিএল দিয়ে ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের বাস্তব চিত্র সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, ভবনের চার ও পাঁচতলার ছাদ ধসে তিনতলায় পড়েছে এবং কলামগুলো ফেটে গেছে। ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় উদ্ধারকাজ করা সমীচীন হবে না ও ভবনটি অপসারণ করতে হলে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষেরও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

কারখানা কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, ৫ আগস্ট থেকে তাদের কারখানা বন্ধ ছিল, তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ অগ্নিকাণ্ডের সময় কারখানায় কর্মরত ছিলেন না এবং তাঁদের কেউ নিখোঁজ নেই।

আগুন লাগার কারণ হিসেবে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্টের আগে প্রতিষ্ঠানে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। তাই তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়, গ্যাস ও বিদ্যুৎ থেকে আগুন লাগেনি। ২৫ আগস্ট গোলাম দস্তগীর বীর প্রতীক গ্রেপ্তারের খবরে এলাকায় লোকজন আনন্দমিছিল বের করেন। একপর্যায়ে দুষ্কৃতকারীরা দুপুরে কারখানায় লুটপাট এবং হেলমেট পরা কয়েকজন দুষ্কৃতকারী রাত সাড়ে ১০টার দিকে কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেন।

৫ আগস্টের ঘটনার পর কারখানা কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তার বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হওয়া উচিত ছিল বলে মত দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ কর্তব্যরত অন্যান্য ফোর্স কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে ২৫ আগস্টের অগ্নিকাণ্ড ঠেকানো যেত।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ

রূপগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানার আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে ভবনটির নিচ তলায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মতৎপরতা। গত ২৭ আগস্ট দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

তদন্ত প্রতিবেদনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধারকাজ সম্পাদন, ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা/গোয়েন্দা/আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক অধিকতর তদন্ত, নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা অধিকতর যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়াসহ ৯ দফা সুপারিশ করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি জানা নেই বলে জানিয়েছেন গাজী টায়ারের নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে তিন-চার দফা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং আগুন লাগানো হয়েছে। ১৮২ ব্যক্তি নিখোঁজের তালিকার বিষয়ে আমরা জানি না। প্রশাসন ওই নিখোঁজের তালিকা করেছে, এখন তাদেরই প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করতে হবে।’

নিখোঁজ ১৮২ ব্যক্তির তালিকা

তদন্ত প্রতিবেদনে গণশুনানিতে পাওয়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার ১ নম্বরে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের শম্ভুপুরার আমান উল্লাহর নাম। তিনি একটি ব্যাটারির কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর ছোট বোন হাজেরা আক্তার বলেন, তাঁর ভাই এক বন্ধুর সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ রয়েছেন। এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

তালিকার ১৬ নম্বরে রয়েছেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের দেয়াপুর গ্রামের তাইতুল ইসলামের ছেলে তাহমিন। তাহমিনের মা খায়রুন নেছা বলেন, ‘ছেলেকে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু তাকে পাইনি।’ আগুনে পুড়ে তাঁর ছেলে মারা গেছেন বলে দাবি তাঁর।

নিখোঁজের তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিখোঁজের বিষয়ে থানায় কোনো জিডি বা মামলা হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও আমাদের কাছে আসেনি। ঘটনার পরে গাজী গ্রুপের পক্ষ থেকে পৃথক ৫টি মামলা করা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু হাড় উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো ডিএনএ টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। নিখোঁজের তালিকার বিষয়ে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তকাজ শুরু করেছে। তাঁরা কি আসলেই নিখোঁজ হয়েছেন বা হননি, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’