‘ভিডার মইধ্যে শুধু ঘরের চালডা আছে, আর সব ভাইসসা গেছে’

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের সামনে ফয়েজ আহমেদ। বুধবার দুপুরে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ভেঙে যাওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করছিলেন ফয়েজ আহমেদ (৪৫)। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। গত ২৩ আগস্ট রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় শত শত বাড়িঘর। এসব বাড়িঘরের মধ্যে রয়েছে ফয়েজের বসতঘর।

ফয়েজ আহমেদ জানান, তিনি কৃষিকাজ করে সংসার চালান। তাঁর আয়ের কোনো পথ নেই। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সাব্বির আহমেদ একাদশ শ্রেণিতে, আর ছোট ছেলে মো. সানি ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। স্ত্রী সালেহা বেগম গৃহিণী।

সেই ভয়াল রাতের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে ফয়েজ বলেন, ‘হেদিন রাউতকা আমি বুড়বুড়িয়া নদীর আইলো আছিলাম। মসিদের মাইকে কইলো ভাঙ্গা পড়ছে। একটা দৌড় দিলাম। দুই পোলা আর বউ লইয়া এক ভাইয়ের বিল্ডিংয়ে পথম উঠছি। পরে পানির হোত (স্রোত) দেইখ্খা একটা স্কুলে গিয়া উডছি। চাইর দিন পর বাইত আইয়া দেহি আমার বাড়িডা শেষ। ভিডার মইধ্যে শুধু ঘরের চালডা আছে, আর সব ভাইসসা গেছে। এহন বাড়ি কেমনে করমু। চারদিকে পানি। রাইতে হাপের (সাপ) ভয়।’

এ কথা বলেই বাড়ির পশ্চিম পাশে একটা বাঁশঝাড় দেখান ফয়েজ। সেখানে তাকাতেই দেখা যায়, ডুবে যাওয়া বাঁশঝাড়ে একটা কালো গোখরো সাপ ফণা তুলে বসে আছে। ফয়েজ বলেন, ‘আইজ দুই দিন ধইরা এরুম দুই চাইরডা করে হাপ দেহা যায়। কেরুম ভয় লাগে, এইডা বুঝাইয়া কইতাম পারতাম না। বাড়ি কেমনে বানায়াম জানি না। সরকার যদি সাহাইয্য না করে, আমি আমার দুইডা পোলা আর বউডারে লইয়া কী থাইক্কাম। কই যায়াম। আল্লাই ভালো জানে। আইজ কয়দিন মাইনষে খানা দেয়। এডি খাইয়া রইছি। আমডার বাড়িডা বহুত দূরে। এর লাইগ্গা ত্রাণ লইয়াও আইতো চায় না মানুষজন। বাড়ির থাইক্কা অনেক দূরে যাইয়া ত্রাণ আনতে হয়।’

বৃহস্পতিবার সকালে বুড়বুড়িয়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গ্রামটির প্রবেশের সড়কটি পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ভাঙা অংশ দিয়ে এখনো তীব্র স্রোতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সড়কের পাশের জমিতে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও বুকসমান পানি। ভাঙা সড়ক দিয়ে স্থানীয় লোকজন খুব সতর্ক হয়ে চলাচল করছেন। সড়কের যে অংশ একটু ভালো, সেখানে ডুবে যাওয়া বাড়িঘর থেকে আসবাব এনে পরিষ্কার করছেন আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে ফিরে আসা লোকজন। সড়কটি ধরে গ্রামের ভেতরে এগিয়ে গেলে ডান পাশে পড়ে ফয়েজের বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল গর্ত। দেখে মনে হবে সদ্য খনন করা পুকুর। বাড়ির উঠোনে হাঁটুসমান কাদা। বাড়ির পশ্চিমে জমিতে বুকসমান পানি। দূর থেকে ভেসে আসা একটি টিনের চালা আটকে আছে জমির আলে।

বন্যার পানিতে খেলায় মেতেছে শিশুরা। বুধবার দুপুরে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস (৮০) বুড়িচংয়ের ইন্দ্রাবতী গ্রামের বাসিন্দা। গোমতীর নদীর বাঁধ ভেঙে তাঁর বাড়িটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এক ছেলে ও দুই মেয়ে তাঁর। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। বছরখানেক আগে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। ছেলের বউ আর দুই নাতনি নিয়ে ধীরেন্দ্র চন্দ্রের পরিবার। ছেলে বিশ্বজিৎ চন্দ্র দাস ওমান থাকেন। তাঁর ভিসার মেয়াদ নেই। ওমানে এখন লুকিয়ে থাকেন। ফলে পরিবারের দুর্দিনে টাকা দিতে পারছেন না।

ইন্দ্রাবতী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ধীরেন্দ্র চন্দ্র তাঁর ভিটাতে বসে কিছু খুঁজছিলেন। প্রতিবেশীরা এসে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। সে গ্রামে আরও অন্তত ১২টি মাটির ঘর বন্যার পানিতে মিশে গেছে। ঘরহারা মানুষগুলো এখন প্রতিবেশীদের ঘরেই থাকেন। এই ঘরহারাদের একজন ধীরেন্দ্র চন্দ্র। তিনি ছেলের বউ ও দুই নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে থাকেন। ঘর পুনর্নির্মাণ না করা পর্যন্ত প্রতিবেশীর বাড়িতেই থাকতে হবে। ইন্দ্রাবতী গ্রামে নদীর ভাঙা বাঁধ দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে ধানি জমিতে। সড়কের কোথাও কোথাও পানি জমে আছে। সড়কগুলো ভেঙে গেছে। হেঁটে চলাচল করা ছাড়া উপায় নেই।

ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, ‘২৩ তারিখ রাউতকা গাঙ ভাইঙ্গা যায়। ভাঙ্গনের খবর পাইয়া পুতের বউ আর নাতনিডিরে লইয়া কোনো রকম ঘরে গিয়ে উঠছি আরেক বাইত। পরের দিন আমার ঘরটা দুরুম করে ভাইঙ্গা লইয়া পড়ে। সাত-আষ্ট দিন পানি আছিল। ঘরের মালসামাল বের করছি পরে। কিন্তু ঘর বাঁচাইতে পারলাম না। রাজমিস্ত্রির খরচ দিয়া ঘরটা বানাইছিলাম। এখন কিতা করি। কেমনে ঘরটা বানাই। আমার পুত বিদেশ গেছে। তার ভিসা নাই। পলাইয়া থাকে। পুতেরও কামাই নাই, ঘরটাও ভাইঙ্গা গেল। এহন আমি পুতের বউ আর দুইডা নাতি লইয়া কেমনে থাহি। আমারে যদি সরকার একটা ঘরের টাকা না দেয়, তাইলে আমি এই মেঘবানের ভিতরে কেমনে থাইক্কায়াম।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবেদ আলী জানান, এখন কুমিল্লার বুড়িচংসহ বন্যাকবলিত ১৪টি উপজেলার যেসব ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রাথমিক হিসাব করা হয়েছে। যার মধ্যে ৮ হাজার ৬৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৪ হাজার ৮১টি ঘরবাড়ি। এই তালিকা ঢাকায় পাঠানো হবে।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের তালিকা শেষ করে আমরা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি সংস্কার কিংবা পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ করে দেওয়ার বিষয়ে শিগগিরই কী সিদ্ধান্ত হয়, তা জানিয়ে দেওয়া হবে।’