দুর্নীতির মামলায় দুদকের অভিযোগপত্র বাতিল, পুনরায় তদন্তের নির্দেশ

সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে একটি হাওরে ঢুকছে পানিফাইল ছবি

সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা সেই আলোচিত মামলায় আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্র বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুদকের অন্য একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

‘তদন্তে পক্ষপাত ও অভিযোগপত্র বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায়’ এক আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গতকাল রোববার এই আদেশ দেন। প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আবেদনকারীর আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ূম।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সুনামগঞ্জের হাওরে ব্যাপক ফসলহানির পর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর ২ জুলাই দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক ফারুক আহমদ বাদী হয়ে সুনামগঞ্জ সদর থানায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সদস্যসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই কর্মকর্তা তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে এজাহারভুক্ত ৩৪ জন আসামিকে বাদ দেওয়া হয়। নতুন করে যুক্ত করা হয় ছয়জনকে।

আরও পড়ুন

দুদকের অভিযোগপত্র বাতিল
অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় নাম থাকা একজন ঠিকাদার ছিলেন টাঙ্গাইলের আকুরটাকুর পাড়ার বাসিন্দা গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আফজালুর রহমান। মামলাটি বিচারের জন্য সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে পাঠানো করা হয়। ওই আদালতে অভিযোগ গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরুর আগে ঠিকাদার আফজালুর রহমান একটি আবেদন জমা দিয়ে দুদকের অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আপত্তি দেন। আদালত তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করলে তিনি হাইকোর্টে একটি রিভিশন মামলা (রিভিশন মামলা নম্বর ৭৬/২০২৩) করেন। গত বছরের ১১ জুলাই হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলার প্রাথমিক শুনানি হয় এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে রুল জারি করা হয়।

আফজালুর রহমানের আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ুম জানান, তাঁরা আবেদনে তদন্ত নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি এবং এই অভিযোগপত্রে বিচার হলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেছিলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা দুইবার এসে আদালতে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারনেনি। পরে আদালত ওই অভিযোগপত্র বাতিল এবং ছয় মাসের মধ্যে পুনরায় তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

দুদকের অভিযোগপত্রের ৩৩ আসামি
মামলার তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ দুদক কর্মকর্তা আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, সেটিতে আসামি হিসেবে ৩৩ জন ছিলেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা দেওয়ানি অপরাধের পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, ১৯ জন ঠিকাদার ও পাউবোর ১৪ কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে প্রতিবছর বন্যা আসার সময় ও আশঙ্কা সম্বন্ধে অবহিত থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি ৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। তাঁদের অর্থ আত্মসাৎ ও অবহেলার কারণেই হাওর অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় কৃষক ও জনসাধারণের আর্থিক ক্ষতি হয়।

তদন্তে বাদ পড়েন যাঁরা
মামলার ৬১ আসামির মধ্যে তদন্তে বাদ পড়েন পাউবোর ৩ প্রকৌশলী, ৩ সেকশন কর্মকর্তা ও ২৮ জন ঠিকাদার। বাদ পড়া প্রকৌশলীরা হলেন সুনামগঞ্জ পাউবোর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই ও সাবেক উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস। সাবেক তিন সেকশন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, বরকত উল্লাহ ভূঁইয়া ও জাহাঙ্গীর হোসেনও বাদ পড়েছেন অভিযোগপত্র থেকে।

ঠিকাদারদের মধ্যে খন্দকার শাহীন আহমেদ, জিল্লুর রহমান, সজিব রঞ্জন দাস, এম এ হান্নান, খায়রুল হুদা, কামাল হোসেন, কাজী নাছিমুদ্দিন, খন্দকার আলী হায়দার, আকবর আলী, রবিউল আলম, আবুল হোসেন, শিবব্রত বসু, মোজাম্মেল হক, বাচ্চু মিয়া, বিপ্রেশ তালুকদার, জামিল ইকবাল, চিন্ময় কান্তি দাস, খাইরুজ্জামান, মফিজুল হক, মোখলেছুর রহমান, রেনু মিয়া, শামসুর রহমান, আবদুল মান্নান, মাহতাব চৌধুরী, লুৎফুল করিম, মো. কেফায়েতুল্লাহ, হুমায়ুন কবির ও ইকবাল মাহমুদ এজাহারে আসামি থাকলেও অভিযোগপত্র থেকে বাদ পড়েন।

আরেকটি মামলা দায়ের
দুদকের মামলার পর একই বছরের ৩ আগস্ট আরেকটি মামলা করে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি। সুনামগঞ্জের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে মামলাটি করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক। এ মামলায় আসামি করা হয় ১৩৯ জনকে। দুদকের মামলার ৬১ আসামিকে এই মামলারও আসামি রাখা হয়। এর বাইরে ৭৮ জন ছিলেন ৩৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানোর আদেশ দেন। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। পরে বাদী এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন দেন। এই আবেদনের শুনানি শেষে আদালত গত বছরের ১৯ জানুয়ারি নারাজি গ্রহণ করেন এবং মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

ঘটনার প্রেক্ষাপট
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪টি হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যায়। হাওরে ফসলহানির পর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর দুদক ১৩ এপ্রিল হাওরের ফসলহানি ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের তদন্তে দুদকের পরিচালক বেলাল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। এরপর ১৫ এপ্রিল পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিনকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ফসলহানির ঘটনায় ৩০ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ২ মে পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) আবদুল হাই, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুদকের অনুসন্ধান শেষে ২ জুলাই মামলা হয়।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে ওই সময় ১৫৪টি হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০ কৃষক পরিবার। যদিও স্থানীয় কৃষকদের দাবি ছিল, সে বছর হাওরের শতভাগ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।