কক্সবাজারের পিএমখালীতে পাহাড় কেটে মাটি ব্যবসার ধুম, প্রশাসন নির্বিকার

কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীতে চলছে সরকারি পাহাড় নিধন। ছবি গতকাল শুক্রবার দুপুরে তোলাছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ছনখোলার ঘোনারপাড়া (তেইল্ল্যাকাটা) এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমি কাটা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বড় আকৃতির পাঁচ থেকে ছয়টি সরকারি পাহাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। পাহাড়ের মাটি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় একটি চক্র। পাহাড় কাটা ও মাটি বিক্রির ব্যবসা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের কোনো তৎপরতা নেই।

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, পিএমখালী-খুরুশকুল এলজিইডি সড়কের ছনখোলা ঘোনারপাড়ার পূর্ব দিকে কাঁচা রাস্তা দিয়ে মাটিবোঝাই ছয়টি ডাম্পার ট্রাক কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছে। একটি ডাম্পারের চালক মনজুর (৩৩) বলেন, এই মাটি শহরের এক ব্যক্তির নিচু জমিতে ফেলা হচ্ছে। প্রতি ট্রাক মাটির দাম ৯৫০ টাকা। দৈনিক পাঁচ থেকে ছয়বার তিনি মাটি টানেন।

এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে আকাশমণি গাছের বিশাল বাগান। ওই বাগানের গাছ কেটে তৈরি করা হয়েছে আরও একটি রাস্তা। বাগানের পরে উঁচু-নিচু সবুজ গাছে ভরপুর ১০ থেকে ১২টি সরকারি পাহাড়। এর মধ্যে শত শত গাছ কেটে ধ্বংস করা হয়েছে প্রায় ১০ একর আয়তনের ৫ থেকে ৬টি সরকারি পাহাড়। দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা বন বিভাগের কর্মকর্তাদের পা পড়ে না।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল কাদের বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাঁচ থেকে ছয়টি পাহাড় কেটে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাটির ব্যবসা চালালেও এসব বন্ধে কারও তৎপরতা নেই। পাহাড় কাটার মাটি ১০ থেকে ১৫টি ট্রাকে ভরে দিনে ও রাতে কক্সবাজার শহর, রামু ও ঈদগাঁও উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। পাহাড় নিধন ও মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তাঁদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন মুখ খোলার সাহস পান না।

১০ একরের ৫ থেকে ৬‍টি পাহাড় থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ২০ হাজার গাছ উজাড় করা হয়েছে। পাহাড়গুলোর অন্তত দুই কোটি ঘনফুট মাটি বিক্রি হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা
রাশেদুল মজিদ, প্রধান নির্বাহী, এনভায়রনমেন্ট পিপল

পাহাড় কাটার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে সম্প্রতি বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন কক্সবাজার সচেতন নাগরিক আন্দোলনের সদস্যসচিব মোরশেদ আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাহাড় নিধন, মাটির ব্যবসাও বন্ধ হচ্ছে না। তিনি বলেন, নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না, কীভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ওবায়দুল করিম পাহাড় কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছেন স্থানীয় আবদুল্লাহ, মোস্তাক, নাছির উদ্দিন, আমিন, লুৎফর, হারুনসহ অন্তত ১২ জনের সিন্ডিকেট। বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের অসাধু কিছু কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে পাহাড় কেটে তাঁরা মাটির ব্যবসা চালাচ্ছেন বলে তাঁর অভিযোগ।

গতকাল ঘটনাস্থল ঘুরে এসে পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’–এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রির ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। ১০ একরের ৫ থেকে ৬‍টি পাহাড় থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ২০ হাজার গাছ উজাড় করা হয়েছে। পাহাড়গুলোর অন্তত দুই কোটি ঘনফুট মাটি বিক্রি হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। পাহাড় কাটার জায়গাটি বন বিভাগের দিঘীরঘোনা বন বিটের এক কিলোমিটারের মধ্যে। সংরক্ষিত এ বনের হাজার হাজার গাছ কেটে মাটি বিক্রির ঘটনায় এখন পর্যন্ত নীরব ভূমিকা পালন করছে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।

সংরক্ষিত বনটির হাজার হাজার গাছ কেটে মাটি বিক্রির ঘটনায় এখন পর্যন্ত নীরব ভূমিকা পালন করছে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর
ছবি: প্রথম আলো

পাহাড় কাটা হচ্ছে জানিয়ে দিঘীরঘোনা বন বিট কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, আগে সেখানে বন বিভাগের সৃজিত বাগান ছিল। এখন প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বাগান আছে। পাহাড় কাটার ঘটনায় ইতিমধ্যে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়েছে। কিন্তু রাতের বেলায় পাহাড় কাটা ও মাটির ব্যবসা চলছে। জনবল সংকটের কারণে ঘটনাস্থলে গিয়ে পাহাড় কাটাও বন্ধ করা যাচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, ঘোনারপাড়ায় ব্যাপক হারে পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। পাহাড় কাটার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেখানে এখন নতুন নতুন সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে।

পিএমখালীতে পাহাড় নিধনের খবর জানা নেই জানিয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড় কেটে মাটি লুটের ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।