ঘূর্ণিঝড় মোখা–আতঙ্কে লাখো রোহিঙ্গা, দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবী
বঙ্গোপসাগর সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার উপকূল থেকে ৯৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। আগামীকাল রোববার দুপুরে মোখা কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল দিয়ে মিয়ানমারে আঘাত হানার কথা বলা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার এই খবরে দুশ্চিন্তায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে থাকা মিয়ানমারের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। মোখা আঘাত হানলে অধিকাংশ রোহিঙ্গার ঘর বিধ্বস্ত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হলে সে ক্ষেত্রে ভূমিধসের ঘটনাও ঘটতে পারে। এতে প্রাণহানির ঘটতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরে তথ্যমতে, সম্ভাব্য গতিপথ ঠিক থাকলে ঘূর্ণিঝড় মোখা আগামী রোববার দুপুরের মধ্যে কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হয়ে মিয়ানমারে আঘাত হানতে পারে। তাতে মোখার কবলে পড়বে উখিয়া ও টেকনাফের মধ্যভাগে গড়ে তোলা আশ্রয়শিবিরগুলো। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলার জন্য আশ্রয়শিবিরগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে আশ্রয়শিবিরগুলো লাল নিশান তুলে দিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সতর্ক করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসে গৃহহীন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য দুই শতাধিক অস্থায়ী কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের আরআরআরসি কার্যালয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা নিয়ে শরণার্থীদের সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ( আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
বৈঠকে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ফায়ার সার্ভিস এবং দেশি–বিদেশি এনজিও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে পাঁচ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে ৪ নম্বর সতর্কসংকেত জারির পর আশ্রয়শিবিরে স্বেচ্ছাসেবীরা লাল নিশান ওড়ানোর পর ঘরে ঘরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সতর্ক করছেন।
সরকারি একজন কর্মকর্তা বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোতে অধিকাংশ রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত, বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তীব্রগতির ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করলে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার ঘরের ছাউনি উড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো রোহিঙ্গাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হতে পারে। এ জন্য আগেভাগে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি গৃহহীন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অন্তত ২০০টি পাকা স্থাপনা (মসজিদ, মাদ্রাসা, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র, ক্যাম্প ইনচার্জের কাযালয়, এনজিও কার্যালয়, লার্নিংসেন্টার ইত্যাদি) খালি করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভারী বৃষ্টি হলে ভূমিধসের ঘটনা ঘটতে পারে। তখন পাহাড়ের ঢালুতে তৈরি রোহিঙ্গা বসতি বিলীন হয়ে প্রাণহানি ঘটতে পারে। আবার পাহাড়ে নিচে গড়ে তোলা আশ্রয়শিবিরে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। তখন পানিবন্দী হাজার হাজার রোহিঙ্গাকেও সরিয়ে আনা হতে পারে।
উখিয়া আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি সৈয়দ হারুন আর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আর্মড পুলিশের প্রস্তুতি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সতর্ক ও সচেতন করা হচ্ছে।
মোখা–আতঙ্কে লাখো রোহিঙ্গা
উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে একটি পাহাড়ের খাদে ত্রিপলের ছাউনিতে স্ত্রী ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন রোহিঙ্গা সানা উল্লাহ। গত ২৫ অক্টোবরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে তাঁর ঘরের ছাউনি উড়ে গিয়ে ছিল। এবারের ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে সানা উল্লাহর মনে আতঙ্ক অনেক।
সানা উল্লাহ (৪৫) বলেন, সিত্রাং আশ্রয়শিবিরে তেমন আঘাত করেনি, এরপরও প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গা ঘর ভেঙে ফেলেছিল। কিন্তু মোখা সরাসরি আঘাত হানতে পারে। তখন আশ্রয়শিবিরের ঘর টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। কারণ, ৯৮ শতাংশ ঘর তৈরি হয়েছে বাঁশের খুঁটির ওপর ত্রিপলের ছাউনিতে। ঝোড়ো হাওয়ায় ছাউনি উপড়ে পড়লে নারী–শিশুদের মাথাগোঁজার ঠাঁই পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
সানা উল্লাহর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজারে। ২০১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নাফ নদী অতিক্রম করে এই আশ্রয়শিবিরে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নেন সানা উল্লাহ। কিন্তু প্রায় ছয় বছরেও মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।
উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা মনির উল্লাহ (৪৭) বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভারী বর্ষণ হলে অন্তত ৩০-৪০টি স্থানে ভূমিধসের (পাহাড়) শঙ্কা আছে। তখন ঘরবাড়ি বিলীন হলে প্রাণহানি ঘটতে পারে। গত পাঁচ বছরে ভূমিধসের ঘটনায় আশ্রয়শিবিরে শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে অন্তত ১৫ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।
কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে আশ্রয়শিবিরে জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা নেই। তবে ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বর্ষণ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলো লন্ডভন্ড করে দিতে পারে।