মাঠে ব্যস্ত ঈশ্বরদীর সেই কৃষকেরা, ঋণ মওকুফ ও মামলা প্রত্যাহারের আবেদন
ঋণের চুক্তিনামা ভঙ্গের মামলায় জামিনে মুক্ত হওয়ার পর আবারও শীতকালীন সবজির মাঠে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পাবনার ঈশ্বরদীর সেই কৃষকেরা। এদিকে ৩৭ কৃষকের পক্ষে ভাড়ইমারী উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমবায় সমিতির সভাপতি আজ বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের কাছে ঋণ মওকুফ ও মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।
মঙ্গলবার ভাড়ইমারী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ৩৭ কৃষকের কেউ বাড়িতে নেই। বাড়ির পেছনে বিশাল সবজির মাঠ। গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগমসহ নানা সবজিতে মাঠ ভর্তি। সেখানে সবাই কাজে ব্যস্ত। কৃষকদের কেউ গাজরের জমিতে, কেউবা ফুলকপি-বাঁধাকপির জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত।
কী দিয়ে কী হলো বুঝবের পারলেম না। ভালোর জন্যি টেকা লিয়ে জেল খাটলেম। লজ্জাও লাগতেছে, কষ্টও পাচ্ছি।
মামলা থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে কাজে ফিরতে পেরে খুশির কথা জানালেন ১৫ জন কৃষক। তাঁরা বলছেন, এখন শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুম। তাই এক বেলা সময় নষ্টের ফুরসত তাঁরা পাচ্ছেন না। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠেই থাকতে হচ্ছে। এর মধ্যে ১২ জন কৃষক দুই দিন জেলে থাকায় এবং অন্যরা পালাতক থাকায় তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন দিনরাত কাজ করে সেই ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করছেন।
কৃষক মহির উদ্দিন বলেন, সমবায় ব্যাংক থেকে তাঁরা একটু সুবিধার জন্যই ঋণ নিয়েছিলেন। তবে সমিতির প্রত্যেকের নামে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও সবাই সমপরিমাণ টাকা নেননি। প্রয়োজন অনুযায়ী কেউ ২০ হাজার, কেউবা ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। তিনি ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ৩০ হাজার পরিশোধ করেছিলেন। ব্যাংকের লোকজন গ্রামে না আসায় বাকি টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। পরে মামলা হবে তা–ও জানতেন না। ফলে এই হয়রানিতে পড়তে হয়েছে।
রাজ্জাক প্রামানিক নামের অপর এক কৃষক জানান, তিনি ৩০ হাজার টাকা নিয়ে সুদসহ ৩৫ টাকা পরিশোধ করেছিলেন। তাঁকে একটি রসিদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এখন কত টাকা তাঁর বাকি আছে, সেটিও তিনি জানেন না।
৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সামাদ প্রামানিক নামের আরেক কৃষক। তিনি বলেন, এর মধ্যে ২০ হাজার পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ব্যাংকের লোকজনও কখনো তাঁদের টাকার জন্য তাগিদ দেননি।
আকরাম প্রামানিক বলেন, ‘কী দিয়ে কী হলো বুঝবের পারলেম না। ভালোর জন্যি টেকা লিয়ে জেল খাটলেম। লজ্জাও লাগতেছে, কষ্টও পাচ্ছি।’
৪০ জন কৃষক ব্যাংক থেকে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে সুদসহ ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। এরপরও ৪০ জন কৃষকের মধ্যে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ঋণ ও ঋণের সুদের মামলা হয়েছে।
তবে শরিফুল ইসলাম নামের এক কৃষক জানান, তিনি ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। সুদসহ পুরো টাকাই পরিশোধ করেছেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।
এদিকে দুপুর ১২টার দিকে ভাড়ইমারী উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমবায় সমিতির সভাপতি বিলকিস নাহার পাবনা শহরের এলএমবি মার্কেটে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকে হাজির হয়ে ঋণ মওকুফ ও মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিয়েছেন। আবেদনটি প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন পাবনা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক কাজী জসিম উদ্দীন।
আবেদনে বিলকিস নাহার উল্লেখ করেছেন, তাঁরা সবাই প্রান্তিক কৃষক। তাঁদের ৪০ জন কৃষক ভাড়ইমারী উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমিতির নামে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে সুদসহ ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। এরপরও ৪০ জন কৃষকের মধ্যে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ঋণ ও ঋণের সুদের মামলা হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে এই কৃষকদের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের পক্ষে এই ঋণ ও ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তাঁদের পক্ষে মামলা চালানোও সম্ভব নয়। তাই তাঁর ঋণ মওকুফ ও মামলাটি প্রত্যাহারের দাবি করছেন।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবেদনটি সদয় দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করছেন বিলকিস নাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইজারা নেওয়া জমিতে সামান্য সবজি চাষ করে এই কৃষকদের জীবন চলে। তাঁরা কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটান। তাঁদের পক্ষে ঋণের সুদের ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তাই এই আবেদন করা হয়েছে।
সমবায় ব্যাংক পাবনা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক কাজী জসিম উদ্দীন বলেন, সমিতির ঋণগুলো মূলত এক বছর মেয়াদি হয়। প্রতি মাসে কিস্তির মাধ্যমে কৃষকেরা এই টাকা পরিশোধ করেন। এই সময়েই প্রতি মাসে তাঁদের কাছে যাওয়া হয়। তবে কৃষকেরা টাকা না দিলে যাওয়া কমে যায়। কৃষকেরা ঋণখেলাপি হন। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী মামলা হয়। এ ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।